বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী এর জীবনী বই pdf
abdul qadir jilani story
মানব সৃষ্টির রহস্য
মানব সৃষ্টির সম্পর্কে হযরত বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) বলিয়াছেন, আল্লাহ সর্বশক্তিমান। আল্লাহ তাআলা মানুষকে কি উত্তম গঠনে সৃষ্টি করেছেন। আর মানুষের এ দুর্বল। দেহে তিনি তার কত সৃষ্টি কৌশল-ইনা প্রকাশ করেছেন।
মানুষ যদি তার কুপ্রবৃত্তিতে রত থাকার স্বভাব ত্যাগ করে তবে সে অবশ্যই স্বীয় বুদ্ধিমত্তার উন্নতির দ্বারা মানবীয় স্বভাবকে ফেরেশতার স্বভাবে পরিণত করতে পারে। মানুষের যদি স্বভাবজনিত শূন্যতা না থাকতাে তবে সে অতি সূক্ষাবস্থা প্রাপ্ত হত। মানব অন্তর এমনই এক ধনভাণ্ডার যাহাতে বিভিন্ন ধরনের অদৃশ্য ও গােপন রহস্য সমূহের সমন্বয় সাধন করা হয়েছে। |
মানুষ আলাে এবং অন্ধকারে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। তার রূহ বা আত্মা এবং দৃষ্টি শক্তি বাহ্যত বিভিন্ন জড়ধর্মী যবনিকায় আচ্ছাদিত । এ আলােকোজ্জ্বল পর্দার জন্যই মহান আল্লাহ। মানুষের পরিচয় দিতে গিয়ে বলিয়াছেন—অবশ্যই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদাশীল করেছি। পরম জ্ঞানী মহান আল্লাহ তা'আলা মানুষের রূপ, গুণ, সৌন্দর্য ফেরেশতাদের কাছে প্রকাশ করেই তাকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। মানুষের দেহসুল ও রূহ সুফ। স্কুল দেহ রূহের দ্বারা পরিপূর্ণ রয়েছে।
সে সত্তা সমুদ্রে জ্ঞান তরীতে আরােহণ করে মহান শক্তি সাগরের দিকে ছুটে যায় । সত্ত্বার দুনিয়াতে নফস হন সেনাপতি। উহা নিজ অনুভূতি স্বরূপ সেনাবাহিনী সমভিব্যবহারে পরস্পর সংগ্রাম করতে সব সময় প্রস্তুত ও সক্ষম। সেনাপতি হল রূহ আর জ্ঞান হল উহার সৈন্যদল । অপর দিকে নফস সত্তার সেনাপতির মালিকের নাম জঘন্য প্রবৃত্তি বা কামরিপু সমূহ যেমন--কামনা বাসনা, লােভ লালসা ইত্যাদি।
সুতরাং জ্ঞান ওজঘন্য প্রবৃত্তি ও উভয় বাদশাহর সৈন্য দলের আল্লাহর আদেশ রূপ মুয়াযযিন অহরহ চীকার করে ঘােষণা করছে হে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বীর সৈনিকগণ । সামনে অগ্রসর হও এবং হে কুপ্রবৃত্তির সাহসী বীরগণ! তােমরা সামনে অগ্রসর হও। আল্লাহর নির্দেশে উভয় পক্ষই সংগ্রামে লিপ্ত এবং একে অপরের উপর বিজয় লাভ মানসে প্রবঞ্চনা, প্রতারণা ও নানারূপ ছলনা কৌশলে প্রয়ােগ করছে।
কিন্তু নেপথ্যে আল্লাহ তাআলা ঘােষণা করেন উভয় পক্ষের সৈন্যগণ পরস্পরকে যতই হারাতে চেষ্টা করছে, আমার সাহায্য ছাড়া কারও পক্ষে তা সম্ভব। নয়। আমার সাহায্য প্রাপ্ত দলই আমার সাহচর্য লাভ করবে। এবং পরকালে সৌভাগ্যশালী রূপে। গণ্য হবে।
আল্লাহ তা'আলার করুণা ও দানই তার সহায়ক। এই দান ও করুণা আল্লাহর অলীগণের প্রতি সর্বদাই প্রবাহিত হয়ে থাকে। তাই হে মানব সম্প্রদায়! তােমরা নিজের নফসের গােলামী। পরিত্যাগ করে জ্ঞানের অনুগামি হও। আর পরম কৌশলী মহান আল্লাহর অতুলনীয় ক্ষমতার প্রতি। গভীর ভাবে দৃষ্টিপাত কর। আর দেখ তিনি কত নিপুণতার সাথে অমর ধামের রূহ এবং ক্ষণভঙ্গুর পার্থিব দুনিয়ার নফসের মধ্যে সমন্বয় করেছেন।
এখন ইচ্ছা করলে এ অদৃশ্য রূহ পাখি আল্লাহ তা'আলা অনুগ্রহ পক্ষ বিস্তার করে স্থূল দেহ পিঞ্জর পরিত্যাগ করে স্বর্গীয় বৃক্ষ শাখায় নীড় রচনা করতে পারে, আর আল্লাহ্ তা'আলার দীদার শাখায় আসন নিয়ে মধুর স্বরে প্রেম সঙ্গীত আওড়াতে পারে এবং মারেফাতের প্রশস্ত অঙ্গন হতে সুক্ষ্মত্বের মহামূল্যবান রত্নভাণ্ডার আহরণ করতে পারে। এবং স্থল নফসকে এর অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে আবদ্ধ রাখতে পারে, কুপ্রবৃত্তির বশে যখন তুমি দেহ।
কাঁচায় আবদ্ধ হবে না অর্থাৎ মাটির দেহ বিনষ্ট হবার পর গূঢ় তত্ত্বের ভাণ্ডার রূপে তােমার হৃদয়। মন যখন সজাগ থাকবে, তুমি মুহূর্তের জন্য আল্লাহর অনুপম সৌন্দর্য ও চিরন্তন নূর দেখতে পাবে। এবং পার্থিব জগতের স্বল্প মেয়াদী, ক্ষণস্থায়ী যাবতীয় বস্তু হতে অনাসক্ত হবে। আল্লাহর দীদারের আয়নায় রূহানী চোখে আলমে মালাকুত এর সৌন্দর্যাবলী তােমার নজরে পড়বে। আর তােমার অন্তর হতে বহির্জগতের সমস্ত প্রভাব বিচ্ছুরিত গােপন রহস্যাবলী প্রকাশের ছত্রছায়ায় হৃদয়ের দৃষ্টিতে বিজয় কেতন উড়তে দেখবে।
হে লােক সকল! স্মরণ রেখ, যখন অলীক কল্পনা, কু ধারণা, কুচিন্তা ও অহমিকা সমূহ। তােমাকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে ফেলে তখন শুধু যথার্থ জ্ঞানই সমুজ্জ্বল নক্ষত্র সম তােমার পথকে আলােকিত করবে। আর এ তত্ত্ব জগতের অগ্রপথিক। আর যখন তােমার মনে অলীক ধারণা, অসার চিন্তা ভাবনার উদয় ঘটে, তখন এ দিব্য জ্ঞানের ফলে জ্ঞানীগণ সকল সন্দেহ দূর করেন। এ জন্যে তােমরা বেশী পরিমাণে যতই জ্ঞানার্জন করবে, ততই তােমাদের জীবনে সার্থকতা আসবে।
abdul qadir jilani story
বড়পীর (রহঃ)-এর খাদ্য
বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর নিজস্ব কিছু জমিজমা ছিল। তা হতেই জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থা হয়ে যেত। তিনি তার খাদেম সহকারে উক্ত জমি চাষাবাদ করতেন এবং প্রচুর। শষ্য উৎপন্ন হত । এবং তা দিয়ে সংসারের ব্যয় ভার নির্বাহ হয়ে যেত । আটা দিয়ে বড় আকারের চারটি রুটি তৈয়ার করা হত এবং তিনি উহা টুকরা করে উপস্থিত লােকজনের মধ্যে বিতরণ করে।
দিতেন এবং অবশিষ্ট অংশ নিজে আহার করতেন। কখনও প্রতিবেশীদের নিকট হতে তােফা। হিসেবে খাদ্য দ্রব্য আসত। তিনি উহা গ্রহণ করতেন না। দেশের রাজা বাদশাহ, ধনবান ও ক্ষমতাশীন লােকদের দেয়া তােফা ও আহার্য বস্তু গ্রহণ না করে গরীবদের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) সাধারণত মধ্যম শ্রেণীর সামান্য পরিমাণ খাদ্য আহার করতেন। আবার কখনও তিনি চার পাঁচ সের আটার রুটি ও মাংসের কাবাব ভক্ষণ করতেন । কখনও আবার একাধারে সাত আটদিন ক্রমাগত উপবাস থাকতেন। কিন্তু কাহারও কাছে হাত পাতা বা সাহায্য চাওয়া তার স্বভাব ছিলনা। আহমদ বাগদাদী নামক তার একজন পরিচালক ছিল।
সে বলিয়াছেন, একদিন বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) জীবিকার সংস্থান করতে না পেরে শুধুমাত্র আল্লাহর উপর নির্ভর করে রইলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এক তােড়া। স্বর্ণমুদ্রা তার নিজের জন্য ব্যয় করবেন। একথা বলে লােকটি গায়েব হয়ে গেল ।
বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তােমরা এ লােককে চেন কি? উপস্থিত লােকজন চুপ করে রইল। অতঃপর তিনি বললেন, ইনিই জিব্রাঈল (আঃ)। আজ তােমাদের বেতন দেয়ার। দিন, অথচ আমার কাছে কিছুই নেই। তাই আল্লাহ তা'আলা জিব্রাঈল (আঃ)-এর মারফতে ইহা। পাঠিয়ে দিলেন।
হযরত বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) অনেক সময় নিজে হাটে বাজারে গমন করে খাদ্য সামগ্রী খরিদ করে আনতেন। তিনি স্বহস্তে আটা পিষে রুটি প্রস্তুত করে নিজে ভক্ষণ করতেন ও অতিথিদের মধ্যে বিতরণ করতেন। মেহমানদের সেবাযত্নে তিনি কখনও খাদেমদের ব্যবহার করতেন না। নিজেই মেহমানদের খেদমত করতেন। মধু, ঘি, দুধ ও দুধজাত খাদ্য বস্তুর প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি।
abdul qadir jilani story
ইমাম আযমের দর্শন লাভ স্বপ্নের মাধ্যমে
তােহফাতুল আসরার গ্রন্থে বর্ণিত আছে, বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ)। নিজেই বলিয়াছেন, একদা আমার অন্তরে এ আশা উদয় হল যে, আমি যদি অদৃশ্য শূন্য জগতে বিচরণকারী কোন মহাপুরুষের দর্শন লাভ করতাম তাহলে আমি শান্তি পেতাম। এ অবস্থায় আমি । নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লাম। এমন সময় স্বপ্নে দেখলাম, হযরত ইমাম আহম্মদ ইবনে হাম্বল (রহঃ)-এর মাজারে একজন জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ শয্যাশায়ী রয়েছেন।
এবং সে স্থান হতে শব্দ। ভেসে আসছে, হে বৎস! দর্শন কর । যার সাক্ষাতের আশা তুমি করছ আমিই তাে সে ব্যক্তি। এ কথা শুনে আমার দ্রিা ভেঙ্গে গেল। অতঃপর পরদিন আমি ইমাম আহাম্মদ ইবনে হাম্বলের মাজারে গমন করলাম এবং সেখানে সত্যিই একজন জ্যোতির্ময় পুরুষকে শায়িত অবস্থায় দেখলাম। কিন্তু তিনি আমার পায়ের শব্দ শােনা মাত্রই নিমিষেই অদৃশ্য হয়ে গেল
তখন আমিও অদৃশ্য হয়ে তার পিছু নিলাম এবং উচ্চস্বরে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, হে মহাপুরুষ! আপনি সত্য করে বলুন আপনি কে? উত্তরে তিনি বললেন, আমি মুসলমানদের সত্য পথের দিশালী। তারপর অদৃশ্য । জগতে আর তর নাগাল পাওয়া গেলনা। তিনি অনন্তে মিশে গেলেন। এ ঘটনার কিছুদিন পর স্বপ্নের মাধ্যমে আমি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে সে মহাপুরুষ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম । উত্তরে তিনি আমাকে বললেন, সে মুসলমানদের ইমাম আযম আবু হানিফা (রহঃ)।
abdul qadir jilani story
মাযহাব গ্রহণ
তখনকার সময় কোন কোন আলেম মাযহাব গ্রহণ করাকে নিরর্থক মনে করত । আবার কেহ কেহ মাযহাব গ্রহণকে বিদআত বলে আখ্যায়িত করতেও দ্বিধাবােধ করত না। এ ধরনের আলেম এখনও আছে। তারা বলেন যে পবিত্র কোরআন এবং সুন্নাহ-ই যথেষ্ট। অন্য কোন কিছুর অনুসরণ করা বাহুল্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
কিন্তু তারা চিন্তা করছেন না যে, পবিত্র কোরআন ও হাদীস। শাস্ত্র হতেই ফিকাহ শাস্ত্রের উৎপত্তি। কোরআন ও হাদীসের মর্ম অনুযায়ী প্রতিটি বিষয়ের হালালহারাম জায়েয না জায়েয, গ্রহণ বর্জন, মনদুব মােবাহ ইত্যাদি নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এজন্যে ফেকাহ শাস্ত্রকে উপেক্ষা করে চলা সম্ভব হয় না। আর এ মাযহাবের শ্রেণী বিন্যাসকারীগণ প্রত্যেকেই একজন ইমাম।
তারা কোরআন ও হাদীসের অনুযায়ী সত্য উদঘাটনে আত্ম নিয়ােগ করেন। এজন্যে প্রত্যেক কোরআন ও হাদীস মান্যকারীগণ প্রকারান্তরে যে কোন মাযহাবের অনুসারী। কারণ কোরআন এবং হাদীসের সাথে মাযহাবের কোনই অমিল নেই। মাযহাবের ভিতর দিয়েই কোরআন হাদীসের মূলতত্ত্বগুলি বিকাশ লাভ করেছে। এ জন্যে বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ আলেম ও পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও মাযহাব গ্রহণ করেছিলেন। জীবনের প্রথম দিকে তিনি মালেকী মাযহাবে ছিলেন পরবর্তী সময়ে হাম্বলী মাযহাব গ্রহণ করেন।
0 Comments
Please Don't Send Any Spam Link