প্রেমের গল্প - প্রেম কাহিনী | অনেক সুন্দর একটি ভালোবাসার গল্প love story book bangla - free bangla love story #2

 অনেক সুন্দর একটি ভালোবাসার গল্প

free bangla love story

গল্পের নাম ( অসম প্রেম কাহিনী )

 Part: 2

শিরীনের কথা শুনতে শুনতে ঝর্ণা মনের মধ্যে কি রকম যেন অস্থিরতা অনুভব করল। কুরআন-হাদিসে কি আছে জানার জন্য প্রেরণা পেল। বলল, তাের কথা শুনে। মনে হচ্ছে, আমরা ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন না করে ঐশ্বর্যের মধ্যে সুখ-শান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছি। যার ফলে এত সুখের নীড় অশান্তিতে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।

এরপর থেকে ঝর্ণা তাদের ঘরে যত ধর্মীয় বই ছিল, সেগুলাে পড়তে পড়তে তার। জ্ঞানের চোখ খুলে গেল। সেগুলাে পড়ে এবং বিভিন্ন বিষয়ে শিরীন ও তার স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করে বুঝতে পারল, আসল জ্ঞান কুরআন-হাদিস না পড়লে অর্জন করা যায়। ।

তারপর সে নামায পড়তে শুরু করল। কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা যত সে পড়তে লাগল, ততই তার মনে যেন এক স্বর্গীয় শান্তি অনুভব হতে লাগল। জীবনে যে এত বড় বিপর্যয় ঘটে গিয়ে তার মন দুঃখের সাগরে ভাসছিল, এখন তার মনে হতে লাগল, সেই সাগেরর তীরের দিকে যেন ক্রমশঃ এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রায় প্রতিদিন সে জায়েদকে চাকরির কথা জিজ্ঞেস করে। একদিন রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ঝর্ণা জায়েদকে বলল, আর কত দিন আপনাদের ঘাড়ে বসে খার? আসলে। আপনি সিরিয়াসলি চেষ্টা করছেন না।

আপনার ধারণা ভুল। চেষ্টার কোনাে ত্রুটি করছি না। আমাদের ক্লিনিকে একজন রিসেপসনিস্ট দরকার। দু’জন মেয়ে ঐ পদে ছিল। একজন বেটার চান্স পেয়ে চলে গেছে। সকাল আটটা থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত ডিউটি। বেতন দেড় হাজার টাকা। আপনি রাজি থাকলে আমি ব্যবস্থা করে দেব। ঝর্ণা কিছু বলার আগে শিরীন বলল, করবে না কেন? তুমি ব্যবস্থা কর। তারপর ঝর্ণাকে জিজ্ঞেস করল, কি রে করবি না? ঝর্ণা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, করব না মানে? নিশ্চয় করব। তারপর জায়েদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ব্যবস্থা করুন।

শিরীন বলল, বেতনটা একটু কম, তা হােক আপাতত এটা কর। পরে বেটার চান্স পেলে ছেড়ে দিবি। | জায়েদ বলল, বেতনটা কম বলে আমি কথাটা বলতে চাই নি। উনি আমাকে চেষ্টা করছি না বলে সন্দেহ করায় বললাম। তবে বিকালের দিকে একটা ছাত্রীকে প্রাইভেটও পড়াতে পাবেন। আমার এক বন্ধুর ভাগ্নি ক্লাস টেনে পড়ে। বেতন মােটামুটি ভালই দেবে।

তবু কত দেবে বলে মনে হয়? আগে যে পড়াত, তাকে এক হাজার দিত। সে সপ্তাহে তিন দিন যেত। উনি যদি সবদিন পড়ান, তা হলে আমি বললে দেড় হাজার দিতে পারে। ঝর্ণা জিজ্ঞেস করল, উনি আপনার কি রকম বন্ধু?

জায়েদ বলল, বন্ধু বন্ধুর মতই। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুত্ব হয়। ছেলেটা একটু বেপরােয়া মতাে হলে কি হবে খুব সরল আর ধার্মিক। সে সময় আমাদের সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন তার কথা মনে হলে খুব দুঃখ হয়।

শিরীন জিজ্ঞেস করল, কেন দুঃখ হয় কেন? জায়েদ বলল, সে কথা শুনলে তােমরাও দুঃখ পাবে। তাছাড়া সব কথা বলতে গেলে রাত ভাের হয়ে যাবে। ঝর্ণা বলল, হােক ভাের, তবু শুনব। যার ভাগ্নিকে পড়াব তার সব কথা জানা দরকার ।। জায়েদ চিন্তা করতে লাগল এদের কাছে বন্ধুর সম্বন্ধে কতটা বলা যায়।

স্বামীকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে শিরীন বলল, চুপ করে আছ কেন? ঝর্ণাতাে ঠিক কথা বলেছে। জায়েদ বলতে আরম্ভ করল, বন্ধুর নাম আরজু। আমি আই. এস. সি পাস করে। মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর আরজুর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ তেমন হত না।

মাঝে মাঝে সংগঠনের মিটিং-এ দেখা হলে আলাপ হত। প্রায় বছর তিনেক হল সংগঠনের সঙ্গে তার যােগাযােগ নেই। সেক্রেটারীকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, সে সংগঠন ছেড়ে দিয়েছে। হঠাৎ দিন পনের আগে আরজু আমাদের ক্লিনিকে পেটের যন্ত্রনার ট্রিটমেন্ট করাতে এলে আমাকে দেখে আনন্দে কোলাকুলি করে ভালােমন্দ জিজ্ঞেস করল।

তাকে। সংগঠন ছেড়ে দেয়ার কথা জিজ্ঞেস করতে বলল, পড়াশােনা ছেড়ে দিয়ে বিলেতে চলে গিয়েছিলাম। বছর খানেক পরে বাবা-মার মৃত্যুর খবর পেয়ে ফিরে আসি। তারপর। আবার চলে যাই। সেখানে পড়াশােনা করতে গিয়ে একটা চাকরি করছি।'

ওর বাবা একজন বড় ব্যবসায়ী জানতাম। জিজ্ঞেস করলাম, পড়াশােনা না করে। সেখানে চাকরি করছ কেন? পড়াশােনা ভালাে না লাগলে বাবার ব্যবসায় নেমে যাও।

আমার কথা শুনে ম্লান হেসে একটা কার্ড দিয়ে বলল, সময় করে দু'একদিনের মধ্যে বাসায় এস, সেদিন তােমার প্রশ্নের উত্তর দেব।' ওকে পরীক্ষা করে দেখলাম ওর লিভার পচতে শুরু করেছে। সে জন্য পেটে যন্ত্রনা হচ্ছে। যারা বেশি মদ খায় তাদের এই রােগ হয়। তাই অবাক হয়ে বললাম, তােমার এই রােগ হল কি করে? আবার ম্লান হেসে বলল, বললাম না, বাসায় এলে সব কথা বলব।

আরজু চলে যাওয়ার পর চিন্তা করলাম, অত ধার্মিক ছেলে মদ ধরল কি করে? আগে ওর কত সুন্দর স্বাস্থ্য ছিল, সব সময় মুখে হাসি লেগে থাকত। এখন কত রােগা হয়ে গেছে। মুখে হাসি নেই। সব সময় বিষাদের ছায়া। ভেবে রাখলাম কালকে ছুটি আছে, যাওয়া যাবে। পরের দিন বেলা দশটার দিকে পুরানা পল্টনে ওদের বাসায় গেলাম। বেশ বড় দোতলা বাড়ি। গেটে দারােয়ান।

আমাকে দেখে সালাম দিয়ে পরিচয়। জানতে চাইল। আমি পরিচয় দিতে গেট খুলে দিল। আমাকে দেখে আরজুর কি। আনন্দ। হাঁক-ডাক করে কাজের মেয়েদের ডেকে নাস্তা পানি করাল। বাড়িতে আর কোনাে লােকজন দেখলাম না। নাস্তা খাওয়ার পর আরজু একজন পয়ত্রিশ বছরের মহিলা ও পনের-ষােল বছরের একটা মেয়েকে সঙ্গে করে এনে বলল, আমার বড় বােন ও তার মেয়ে। তারপর আমাকে দেখিয়ে তাদেরকে বলল, আমার বন্ধু।

এ ডাক্তার। এর কাছেই টিটমেন্ট করাচ্ছি। আরজুর বড় বােনকে তেমন প্রফুল্ল দেখলাম না। তবে তার মেয়েটা খুব সুন্দর। হাসি-খুশী ভাব। সালাম বিনিময়ের পর ভদ্রমহিলা দু'একটা কথা জিজ্ঞেস করে মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন। দুপুরে না খাইয়ে ছাড়ল না। তার আগে আমার কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে বাসায় ফোন করে সে কথা জানিয়ে দিল। খাওয়াদাওয়ার পর বিশ্রাম নেয়ার সময় আমার মনে অনেক কিছু জানার ইচ্ছা হল। অতবড় বাড়িটাকে মৃত্যুপুরী বলে মনে হল।

চিন্তা করলাম, নিজেদের লােক কম, ভাড়া না দিয়ে। ফেলে রেখেছে কেন? আরজু বিয়ে করেছে বলেও মনে হল না। ইচ্ছাগুলাে চেপে রাখতে পেরে জিজ্ঞেস করতে যা বলল, তা বিশ্বাস করতে আমার অনেক সময় লেগেছিল। শিরীন বলে উঠল, কই, তুমি তাে তার কথা কখনাে বল নি? জায়েদ বলল, শুনে তুমি দুঃখ পাবে ভেবে বলি নি। আজ তােমরা একান্ত শুনতে চাচ্ছ বলে বলছি। ঝর্ণা শিরীনকে বলল, তুই থামততা, মাঝখান থেকে ডিস্টার্ব করিস না। তারপর জায়েদকে বলল, বলুন।

জায়েদ আবার বলতে আরম্ভ করল, আরজু উত্তর বঙ্গের ছেলে। স্কুলে ক্লাস টেনে পড়তে পড়তে কি একটা গােলমাল করে ঢাকায় পালিয়ে আসে। এসে প্রথমে কোনাে কাজ না পেয়ে রিক্সা চালাত। তারপর এক সাহেবের কৃপা দৃষ্টিতে পড়ে। সাহেবের। একটা মাত্র ছেলে ছিল। কলেজে পড়ার সময় মারা যায়। ছেলের শােকে সাহেবের স্ত্রী।

পঙ্গু হয়ে যান। ওনারা আরজুকে নিজেদের ছেলে করে নেন। আরজুও তাদেরকে মাবাবা বলে ডাকত। সাহেব তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। তারপর ভার্সিটিতে পড়ার সময় একদিন বাসায় কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ বিলেতে চলে যায়। কেন গেল জিজ্ঞেস করতে বলল, সে কথা এখন বলতে পারবে না। বিলেতে কিছু দিন পড়াশােনা

করে। তারপর পড়াশােনা ছেড়ে দিয়ে চাকরি করতে থাকে। প্রায় বছর খানেক পর সে বাড়িতে চিঠি দেয়। ততদিন আরজুর শােকে সাহেব ও তার স্ত্রী মারা গেছেন। সাহেব। মারা যাওয়ার আগে সবকিছু আরজুকে উইল করে দিয়েছিলেন। যে ব্যারিস্টারকে দিয়ে উইল করিয়েছিলেন, সাহেবের মৃত্যুর পর সেই ব্যারিস্টার আরজুর চিঠি আসার পর সব কিছু জানিয়ে ফিরে আসতে বলেন। আরজু এসে বছর খানেক ঢাকায় থেকে ব্যবসায় মন দিল। খুব বুদ্ধিমান ছেলে। কিছুদিনের মধ্যে ব্যবসা করে প্রচুর টাকা রােজগার করল ।

এর মধ্যে দেশে গিয়ে মা, বাবা, বিধবা বােন ও তার মেয়েকে নিয়ে আসে। গুলশানে একটা বাড়ি করেছে। মা-বাবাকে আনার পর সে সেই বাড়িতে থাকে। প্রতিদিন ৪ দুপুরে এ বাড়িতে খেতে আসে। কয়েক মাস পরে তার মা-বাবা দু’মাসের ব্যবধানে মারা যায়। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর ম্যানেজারের হাতে ব্যবসার ভার তুলে দিয়ে আবার বিলেতে চলে যায়। ব্যবসায়িক কারণে ম্যানেজারের চিঠি পেয়ে এসেছে। একবার ১ সাহেব তার বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে আরজুর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

আরজ ভাসিটিতে পড়ত। বিয়ের কথা শুনে তাদেরকে বলে, আমি চিরকুমার থাকব। তাতে যদি আপনারা অসন্তুষ্ট হন, তা হলে বলুন আমি এখান থেকে চলে যাব। ওনারা আরজুর। মধ্যে নিজের ছেলেরমতাে ডেসপ্যারেট ভাব লক্ষ্য করছেন। সেই ছেলে যা বলত তার। একচুল নড় চড় করত না। তাই আরজুর কথা শুনে ঐ ব্যাপারে আর কিছু বলেন নি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তােমার যে অসুখ হয়েছে,

তা হেভী মদখােরদের হয়। তা হলে কি তুমি মদ খাও? আরজু একটু গম্ভীর হয়ে বলল, বুঝতেই যখন পেরেছ তখন আবার জিজ্ঞেস করছ। কেন? খুব অবাক হয়ে বললাম, কিন্তু তােমার মতাে ছেলে মদ খাবে এটা বিশ্বাস করতে । পারছি না।

আরজু করুণ স্বরে বলল, পৃথিবীতে এমন অনেক জিনিস ঘটছে, তা বিশ্বাস করা । যায় না। বললাম, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করাে না। তুমি চিরকুমার থাকতে । চাইছ কেন?

আমার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘ। নিঃশ্বাস ফেলে ছলছল নয়নে আমার দিকে চেয়ে বলল, একটা মেয়ের অপেক্ষায়।

আরজুর চোখে পানি দেখে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, সেই মেয়ে কি জানে তুমি তার প্রতীক্ষায় আছ? মুখে কিছু না বলে আরজু শুধু মাথা নাড়াল। খুব আশ্চার্য হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, সেই মেয়েকে নিশ্চয় ভালবেসেছিলে? শুধু ভালবেসেছিলাম না, আজও বাসি এবং মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বেসে যাব। সেও কি তােমাকে ভালবাসে? না, সে আমাকে ঘৃণা করে।

আশ্চর্য! এরকম ঘটনাও ঘটে তা হলে? আচ্ছা, তুমি যে এত ভালবাস সে কি তা জানে? জানে। আর জানে বলে আমাকে জব্দ করার জন্য অন্য একজনকে ভালবেসে বিয়ে। করেছে। আরজুর কথা শুনতে শুনতে আমার বিস্ময় উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল ।

বললাম, এতকিছুর পরও তুমি তাকে আমৃত্যু ভালবাসবে? বাসব। কেন জান? সেই মেয়েটাকে ছােটবেলা থেকে শুধু ভালবাসি নি, সে আমার অন্তরে এত গভীরভাবে বাসা বেঁধে আছে, সেখান থেকে সরান কিছুতেই সম্ভব নয়। যে। কটাদিন বাচব তার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকব। তারপর সামলে নিয়ে চোখ মুখ মুছে বলল, আজ পর্যন্ত কাউকে এসব কথা বলি নি। ভেবেছিলাম, কাউকে আমার দুর্ভাগ্যের কথা জানাব না। কিন্তু তােমাকে কেন যেন বলে ফেললাম। একটা অনুরােধ করব রাখবে? বললাম, রাখব না কেন?

আমার এই ভাগ্নির জন্য একজন মহিলা টিউটর জোগাড় করে দেবে? বুবু আবার কোনাে পুরুষ টিউটর রাখতে চায় না। বললাম, ঠিক আছে চেষ্টা করব। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম চারটে বেজে গেছে। এবার আমি যাই, আমাকে ক্লিনিকে যেত হবে। চা-নাস্তা খেয়ে ফিরে এলাম। এই হল আমার বন্ধুর হিন্ত্রী।

তারপর ঝর্ণাকে জিজ্ঞেস করল, এখন বলুন, আপনি আমার বন্ধুর ভাগ্নিকে পড়াবেন কিনা? ঝর্ণা এতক্ষণ শুনতে শুনতে চিন্তা করছিল, সাইফুলের সঙ্গে ওনার বন্ধুর হিস্ত্রীর অনেক মিল রয়েছে। সে নয় তাে? আবার চিন্তা করল, তা কি করে হয়? এনার নাম তাে আরজু। জায়েদের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, আপনার বন্ধুর হিন্ত্রী বড় রােমাঞ্চকর ও দুঃখ জনক। দেখুন কথা বলে, আমার কোনাে আপত্তি নেই।

জায়েদ বলল, সেদিন বলেছিল বেশিদিন সে থাকবে না। দাঁড়ান টেলিফোন করে দেখি আছে কিনা। টেলিফোন ইনডেক্স থেকে নাম্বার নিয়ে ডায়েল করল। রিং হচ্ছে কেউ ধরছে না। ঘড়ির দিকে তাড়িয়ে দেখল, রাত সাড়ে বারটা। হেঁসে উঠে বলল, বন্ধর ইতিহাস বলতে বলতে টাইমের কথা ভুলে গেছি। সাড়ে বারটার সময় কেউ। কাউকে টেলিফোন করে নাকি? রিসিভার রাখতে যাবে এমন সময় ওপাশের রিসিভার। তােলার শব্দ পেল। একটু পরে একটা তরুনীর কণ্ঠস্বর শােনা গেল-কত নাম্বার চান?

আরজর ভাগ্নি নাজনীন নিজের রুমে পড়ছিল। ঘুমাতে যাওয়ার আগে দরজা বন্ধ। করতে এসে বারান্দায় টেলিফোন বাজতে শুনে ফোন ধরেছে। জায়েদ নাম্বার বলল। নাজনীন বলল, কাকে চান? মামাকে? হ্যা।।
মামা তাে এ বাসায় থাকেন না। গুলশানের বাসায় থাকেন। ওখানকার ফোন। নাম্বার জানেন? না, আপনি বলুন।

নাজনীন নাম্বার বলে বলল, সকাল আটটার মধ্যে করবেন। এখন উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আরজু এ বাসায় বলে রেখেছে, রাত্রে তাকে কেউ ফোন করলে ঘুমিয়ে পড়েছে বলতে।। | তাই করবাে বলে জায়েদ রিসিভার ক্রাডেলে রেখে বলল, কাল তার অফিসে। একবার ফোন করে যােগাযােগ করব। এখনও তা হলে সে বিলেত চলে যাই নি।

পরের দিন মেডিকেল থেকে জায়েদ আরজুর অফিসে ফোন করে পেল না। বিকেলে ক্লিনিকে এসে আবার ফোন করার জন্য ডায়েল করছে এমন সময় তাকে স্বশরীরে ঢুকতে দেখে রিসিভার রেখে সালাম ও কুশলাদি বিনিময় করে বলল, তােমাকে। এক্ষুনি ফোন করছিলাম। আরজু হাসি মুখে বলল, আমার সৌভাগ্য। যাক, কি জন্যে ফোন করছিলে বল?

জাযেদ পিয়নকে দুটো চায়ের অর্ডার দিল। তারপর বলল, আগে তােমার বিলেত যাওয়ার খবর বল। কাল সকালের ফ্লাইটে যাচ্ছি। কতদিনে ফিরছ? তা এখন ঠিক বলতে পারছি না। কেন? ভাবছি সহসা ফিরব না।। তা কি করে হয়? এখানকার ব্যবসা, বাড়িঘর দেখাশুনা করবে কে?

ম্লান হেসে আরজু বলল, ওসবের ওপর আমার তেমন কোনাে টান নেই। ম্যানেজারকে বলেছি দেখতে। আর মাঝে মাঝে আমিও আসব। বুবু আর তার মেয়ে না থাকলে হয়তাে আর আসতাম না। আমার কথা বাদ দাও, কেন ফোন করতে যাচ্ছিলে বল।।

মানে আমার স্ত্রীর এক বান্ধবি ভাগ্য বিপর্যয়ে পড়ে আমাদের কাছে এসে উঠেছে। মেয়েটা শিক্ষিতা। তুমি সেদিন তােমার ভাগ্নিকে পড়াবার জন্যে প্রাইভেট টিউটরের কথা বলেছিলে না, সেই ব্যাপারে আলাপ করতে চেয়েছিলাম।
Super bangla love story book

ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা শুনে আরজুর নিজের ভাগ্যের কথা মনে পড়ল। মৃদু হেসে বলল, যাদের ভাগ্যে বিপর্যয় আসে, পরে আবার তাদের ভাগ্যে সৌভাগ্যও আসে। ঠিক আছে, উনি কাল থেকে পড়াতে আসুক। আমি বুবুকে সে কথা বলে রাখব।

আমার ফ্লাইট খুব ভােরে। তুমি প্রথম দিন বাসা চিনিয়ে দিও। খুব ব্যস্ত আছি, এখন চলি। যাওয়ার আগে তােমার সঙ্গে একটু দেখা করতে এলাম বলে দাড়িয়ে আবার বসে বলল, তােমার ফোনটা একটু এদিকে দাওতাে। এক সপ্তাহ আগে ম্যানেজার তার একজন পি.এ. দরকার জানিয়েছিল। তাকে আমি অর্ডারও দিয়েছিলাম। ফোন করে দেখি সেই পােস্ট খালি আছে কি না।

জায়েদ ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল, তােমার অফিস এখনও খােলা আছে? ম্যানেজারের বাসায় ফোন করব। তারপর ফোন করে তার সঙ্গে আলাপ করে। ফোন ছেড়ে দিয়ে বলল, তােমার স্ত্রীর বান্ধবীর সৌভাগ্যের চাবি এখন থেকেই হাতে। আসতে আরম্ভ করল। তারপর একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে তার উল্টো দিকে

দ’কলম লিখে সিগনেচার দিয়ে বলল, এটা নিয়ে কালই অফিস আওয়ারে যেতে বলবে। আমি ম্যানেজারকে বলে দিয়েছি, এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিয়ে দেবেন। আর ওনাকে বায়ােডাটা ও ছবিসহ একটা এপ্লিকেশন নিয়ে যেতে বলবে। দেখছে, ভাগ্য কাকে বলে? একসঙ্গে দুটো চাকরি। প্রাইভেট টিউটর ও ম্যানেজারের পি.এ.। যাক, উঠি তা হলে, এখনাে অনেক কাজ বাকি আছে। তারপর হাত মােসাফাহা ও সালাম বিনিময় করে আরজু চলে গেল।

জায়েদ রাত্রে বাসায় ফিরে স্ত্রী ও ঝর্ণাকে সব কথা জানাল। শুনে দুজনে আল্লাহর শােকর আদায় করল। জায়েদ ঝর্ণাকে জিজ্ঞেস করল, কোনটা করবেন? আমাদের ক্লিনিকের। রিসেপসনিস্ট, না অফিসের ম্যানেজারের পি. এ? আমার মনে হয় ক্লিনিকের চেয়ে অফিসের চাকরিটা ভালাে।।

শিরীন বলল, অফিসের বেতন স্কেল কত এবং প্রাইভেট পড়াবার জন্য কত দেবে জিজ্ঞেস কর নি?। জায়েদ বলল, যে নিজে থেকে সব কিছু ব্যবস্থা করল, তাকে কোন মুখে বেতনের কথা জিজ্ঞেস করব?

ঝর্ণা বলল, ডাক্তার ভাইয়ের কথা ঠিক। উনি যে নিজের থেকে এতকিছু করলেন সেটাই যথেষ্ট। এরপর বেতনের কথা ভােলা প্রেসটিজের ব্যাপার না? দিন দুই পরে ঝর্ণা বােরখা পরে সময় মতাে অফিসে গিয়ে পিয়নকে জিজ্ঞেস করতে সে ম্যানেজারের কাছে নিয়ে গেল।

ম্যানেজার খুব সৎলােক। অনেক দিন থেকে এখানে কাজ করছেন। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। সৌম্য শান্ত চেহারা। তিনি একমনে একটা ফাইল দেখছিলেন। ফাইলের কাজ শেষ করে সেটা বন্ধ করার সময় বােরখা পরা একটা অপূর্ব সুন্দরী। মেয়েকে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলেন, কে আপনি? কেন এসেছেন বলুন?

ঝর্ণা ম্যানেজারের রুমে ঢুকে মুখের নেকাব সরিয়ে দিয়েছে। ম্যানেজারের কথার উত্তরে সালাম দিয়ে সব কাগজপত্রের সঙ্গে আরজুর দেয়া কার্ডটাও দিল। ম্যানেজার সেগুলাের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে তটস্থ হয়ে তাকে বসতে। বলে বললেন, কিছু মনে করবেন না। ছােট সাহেব বিলেত যাওয়ার আগের দিন তা হলে আপনার ব্যাপারে আমার সঙ্গে আলাপ করছিলেন। কিন্তু আপনি যে পর্দানসীন। মহিলা সে কথা বলেন নি। তারপর তার কি কাজ বুঝিয়ে দিয়ে কলিংবেল বাজিয়ে।

bangla love story books

free bangla love story book

পিয়নকে ডাকলেন। পিয়ন আসার পর ঝর্ণাকে বললেন, আপনি ওর সঙ্গে আপনার। রুমে যান। আমি এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়ে দিচ্ছি। ম্যানেজারের পাশের রুমটা পি.এ.র জন্য ঠিক করা হয়েছে। পিয়ন ঝর্ণাকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। ঝর্ণা নিজের সিটে বসে রুমটার চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ম্যানেজারের রুমটার মতাে এ রুমও এয়ার কন্ডিশান করা। মেঝেয় কার্পেট বিছান। টেবিলের। উপর পুরু কাচ। এক সাইডে একটা স্টীলের নতুন আলমারী। চাবিটা কীহােলে

লাগান। তার পাশে ... স্টীলের সেলফ। থরে থরে ফাইল সাজান রয়েছে। টেবিলের এক পাশে ইনটারকম রয়েছে। | একটু পর পিয়ন এসে একগ্লাস পানি টেবিলের এক পাশে রেখে সিরামিকের ছােট প্লেট চাপা দিয়ে চলে গেল।
ঝর্ণার পিয়াস লেগেছিল। পানিটা খেয়ে গ্লাস রাখছে এমন সময় ইন্টারকমে পিক পিক শব্দ হতে রিসিভার তুলে কানের কাছে ধরতে ম্যানেজারের গলা শুনতে পেল, আট নাম্বার। ফাইলটা নিয়ে আসুন। ঝর্ণা সেলফের কাছে গিয়ে ফাইল নিয়ে ম্যানেজারের রুমে এল।

ম্যানেজার তাকে বসতে বলে ফাইলটা খুলে কি করতে হবে বুঝিয়ে বললেন, প্রথম। প্রথম একটু অসুবিধে হবে। পরে ঠিক হয়ে যবে। এবার যান, যা বললাম সেভাবে কা=ে করুন। কোনাে অসুবিধে হলে আমার কাছে আসবেন, বুঝিয়ে দেব।
এ দিন ফেরার পথে ঝর্ণা ভাবল, আজ সাহেবের বাসায় গিয়ে ছাত্রীর সঙ্গে আলাপ করে যাই, কাল থেকে পড়ান যাবে। গেটে দারােয়ান বাধা দিলে ঝর্ণা পরিচয় দিতে গেট খুলে দিল। ঝর্ণা ভিতরে গিয়ে বারান্দায় উঠে একটা কাজের মেয়েকে দেখতে। পেয়ে বলল, আমি সাহেবের ভাগ্নিকে পড়াতে এসেছি।

কাজের মেয়েটা তাকে সঙ্গে করে ড্রইংরুমে বসিয়ে ভিতরে খবর দিতে চলে গেল । একটু পরে ফিরে এসে অন্য একটা রুমে নিয়ে গেল। | ঝর্ণা রুমে ডুকতেই বুঝতে পারল, এটা ছাত্রীর রুম। একদিকে একটা শােবার খাট। অন্য দিকে একটা টেবিল। তারপাশে দেওয়ালের গায়ে বুক সেলফ। টেবিলের উপর ছিব্বা ঢাকা একটা প্লেট। পাশে পানির জগ ও গ্লাস।

কাজের মেয়েটা ঝর্ণাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, আপনি অফিস থেকে তাে আসছেন, তাই আপা বললেন, ওনাকে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে নিতে বল। নাজনীন। একটু পরে আসবে। কথা শেষ করে চলে গেল।

ঝর্ণা দুপুরে কিছু খায় নি। প্রথম দিন বলে খাবার সঙ্গে আনে নি। সে খুব ক্লান্ত ও। ক্ষুধা অনুভব করছিল। কাজের মেয়েটা চলে যাওয়ার পর এটাচড বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে নাস্তা খেয়ে রুমালে হাত-মুখ মুচছে এমন সময় দেখল, স্যালােয়ারকামিজ পরা একটা ফুটফুটে সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে সেই কাজের মেয়েটা এক কাপ চা। নিয়ে আসছে। বুঝতে পারল, এ মেয়েটাই সাহেবের ভাগ্নি। নাজনীন কাছে এসে সালাম দিল।

আর কাজের মেয়েটা চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে ফিরে গেল। ঝর্ণা সালামের উত্তর দিয়ে তাকে বসতে বলল। নাজনীন বসার পর চা খেয়ে কাপটা টেবিলের একপাশে মেঝেয় রেখে বলল, আজ পড়াতে আসি নি, তােমাদের সঙ্গে আলাপ করতে এলাম। কাল থেকে পড়াব। তােমার নাম কি ? নাজনীন নাম বলল। তােমার আম্মাকে ডেকে আন, আলাপ করব।

নাজনীন চলে যাওয়ার পর ঝর্ণা একটু ভয়ে ভয়ে চিন্তা করতে লাগল, যদি আরজু সাইফল হয়, তা হলে তার বােন আমাকে চিনে ফেলতে পারে। আচ্ছা, আমিও কি। তাকে চিন্তেত পারব ? সে তখন সাইফুলের বড় বােনের মুখ মনে করার চেষ্টা করল।

কিন্তু কত বছর আগে কয়েকবার মাত্র তাকে দেখেছে, তাই মনে করতে পারল না।। কিছুক্ষণ পরে বাইরে পায়ের শব্দ পেয়ে দরজার দিকে তাকাল।। একটু পরে নাজনীনের সঙ্গে মনিরা পর্দা ঠেলে রুমে ঢুকে এগিয়ে এল। ঝর্ণা দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে চিনবার চেষ্টা করল। কিন্তু মনে। করতে পারল না।।

মনিরা কাছে এসে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, দাড়ালেন কেন বসুন। তারপর ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে চেনা চেনা লাগল। কিন্তু ঠিক কোথায় দেখেছে মনে করতে পারল না। ভাবল, হয়তাে এনার মতাে কোনাে মেয়েকে কোথাও দেখেছে। তার মুখের দিকে নাজনীনের আম্মাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঝর্ণা ভয়ে ভয়ে।

আলাপ করার চেষ্টা করল। মনিরা বেশিক্ষণ বসল না, দু’চারটে কথা বলে চলে গেল। ঝর্ণা নাজনীনকে জিজ্ঞেস করল, তােমার আম্মা কি অসুস্থ? নাজনীন বলল, না। আমার নানা-নানি মারা যাওয়ার পর থেকে আম্মা সব সময়। গম্ভীর হয়ে থাকে। কারাে সঙ্গে বড় একটা কথা বলে না। ঝর্ণা বলর, ঠিক আছে, আজ তা হলে চলি, কাল এসে পড়াব।

শিরীন জানে আজ ঝর্ণা অফিসের পর সাহেবের ভাগ্নিকে পড়াতে যাবে। তাই দেরি। করে ফেরার জন্যে কৈফিয়েৎ না চেয়ে জিজ্ঞেস করল, কিরে, ছাত্রী কেমন? তাদের বাসার লােকজন দেখে কি মনে হল? ঝর্ণা বলল, ডাক্তার ভাই তাে সেদিন তাদের বাসার সব কথা বললেন। ছাত্রী মােটামুটি ভালাে হবে বলে মনে হয়।

পরের দিন থেকে ঝর্ণা প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে নাজনীনকে পড়িয়ে বাসায় আসে। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে ঝর্ণা নিজের দুটো শাড়ি, ব্লাউজ ও সায়া এবং শিরীনের জন্য একটা ভালাে শাড়ি ও ডাক্তার ভাইয়ের জন্য একটা পাঞ্জাবী কিনে আনল। ঝর্ণা। প্রাইভেট পড়িয়ে ও অফিসের বেতন বাবদ মােট সাড়ে চার হাজার টাকা আজ পেয়েছে।

তাদের জন্য কাপড় কিনেছে দেখে শিরীন কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ঋণ পরিশােধ। করতে চাচ্ছিস? ঝর্ণা বলল, তােদের ঋণ কি আমি জীবনভাের শােধ করতে পারব? রাগ করছিস। কেন? তােদেরকে খুশী করার জন্য দিচ্ছি না, প্রথম রােজগারের টাকা পেয়ে নিজের খুশীর জন্য দিলাম।

কয়েকদিন পর ঝর্ণা শিরীনের সামনে জায়েদকে বলল, আপনাদের ঘাড়ের ওপর বসে এতদিন খেলাম। এখন তাে উপায় করছি। এবার নিজের ভার নিজেকে বহন করার সুযােগ দিন। সেই সঙ্গে আমার ডিভাের্সের ব্যবস্থা করে দিন। জায়েদ বলল, আরাে কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখুন, উনি কি করেন। আর আপনিও ভাবনা চিন্তা করুন।

সে কি করবে না করবে তা জানার আমার দরকার নেই। তা ছাড়া তার কোনাে মতামত আমি মেনে নেব না। আর আমার ভাবনা চিন্তা করারও কিছু নেই। এ জীবনে আমি আর তার কাছে ফিরে যাব না।।

তবু কিন্তু কিছু কথা থেকে যাচ্ছে। শিরীন বলে উঠল, এর মধ্যে আবার কি কথা থাকতে পারে? ঐ পাষণ্ডের সঙ্গে আর মিটমাট হতে পারে না। ঝর্ণা যা বলল, তাই কর।। জায়েদ বলল, ঠিক আছে, একদিন সময় করে আপনাকে একজন উকিলের কাছে নিয়ে যাব। তারপর ঝর্ণাকে বলল, এখানে আপনার কি এমন অসুবিধে হচ্ছে, যে জন্য। ঘাড়ে বসে খাওয়ার কথা বলছেন?

অসুবিধে কেন হবে, বরং সুখেই আছি।
শিরীন বলল, তুই এখানেই থাকবি। কোথাও তাের যাওয়া চলবে না। একা মেয়েছেলেকে কেউ সহসা ঘর ভাড়া দেবে না। আর যদিও বা কেউ দেয়, তাের সেখানে একা থাকাও ঠিক হবে না। সেই পাষণ্ডটা তােকে এত সহজে ছেড়ে দেবে বলে মনে করেছিস বুঝি? ঐ রকম ধরণের লােকেরা বড় ডেঞ্জারার্স। রাস্তা-ঘাটে তুই একা। চলাফেরা করার সময় খুব সাবধানে থাকবি। তাই বলে কতদিন তােদের ঘাড়ে বসে খাব? অবশ্য আমাকে পেয়িংগেস্ট হিসাবে। রাখলে অন্য কথা।

শিরীন একটু রাগের সঙ্গে বলল, রােজগার করতে শিখে টাকার গরম দেখাচ্ছিস? তুই ভুল বুঝচ্ছিস কেন? বিপদের সময় তােদের কাছ থেকে যে উপকার পেয়েছি, চিরকাল সে জন্য কৃতজ্ঞ থাকব। এখন আল্লাহ আমাকে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন, এখনাে পরগাছার মতাে থাকা কি উচিত?

শিরীন বলল, ঠিক আছে, তাের যা মনে চায় তাই কর। কিন্তু তােকে একা অন্য কোথাও থাকতে দেব না।। কাদেয় ক্লিম সুকান্ত এক বছর হতে চলল ঝর্ণা শিরীনদের বাসায় পেয়িংগেস্ট হিসাবে থেকে চাকরি করছে এবং নাজনীনকে প্রাইভেট পড়াচ্ছে। নাজনীন ঝর্ণার কাছে প্রাইভেট পড়ে ফাস্ট ডিভিশনে এস.এস.সি. পাস করল। পরীক্ষার পর ঝর্ণা প্রতিদিন নাজনীনকে শুধু গ্রামার ও ট্রানশ্লেসান করাতে আসে।

যে দিন রেজাল্ট বের হল, সেদিনও ঝর্ণা পড়াতে এল। সে অফিসে খবরের কাগজে নাজনীনের রােল নাম্বার দেখে তার রেজাল্ট জেনেছে। নাজনীন নিজের রুমে আন্টির জন্য অপেক্ষা করছিল। সে ঝর্ণাকে আন্টি বলে ডাকে। ঝর্ণা ঘরে ঢুকতে এগিয়ে এসে প্রথমে সালাম দিয়ে বলল, আন্টি আজ আমাদের রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমি ফাস্ট ডিভিশানে তিনটে লেটার পেয়ে পাশ করেছি। তারপর সে কদমবুসি করল।

ঝর্ণা তার মাথায় হাত চুয়ে চুমাে খেয়ে হাসি মুখে বলল, আমি অফিসে পেপার দেখে আগেই জেনেছি।। আন্টি, আজ পড়তে ইচ্ছে করছে না। বেশ তাে, না হয় না পড়লে, তাতে কি? আজ কি আর কেউ পড়াশােনা করতে পারে? আপনি বসুন, আমি আসছি বলে নাজনীন চলে গেল। একটু পরে একটা প্লেটে বেশ কয়েক রকমের মিষ্টি নিয়ে ফিরে এসে টেবিলের উপর রেখে বলল, আম্মা মিষ্টি মুখ করতে বলল। ঝর্ণা বলল, তা তাে করবই। তুমি খাও।। একটু আগে আম্মা আমাকে খাইয়েছে।

ঝর্ণা মিষ্টির প্লেটের ঢাকা দেয়া প্লেটে তিন চারটে মিষ্টি তুলে দিয়ে বলল, আম্মা খাইয়েছে এবার আন্টি খাওয়াবে। নাও এগুলাে খেয়ে ফেল। নাজনীনের খাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও আদব রক্ষার্থে দুটো খেল। তারপর বলল, আজ মামার চিঠি এসেছে। আমার রেজাল্টের খবর জানাতে বলেছেন। জানেন আন্টি, মামার অসুখ আরাে বেড়ে গেছে। ঝর্ণারও খাওয়া শেষ হয়েছে। এমন সময় মনিরা এসে ঝর্ণাকে সালাম দিল।

সেই প্রথম দিনের পর ছাত্রীর মাকে দীর্ঘ এক বছর পরে তার কাছে আসতে দেখে ঝর্ণা বেশ অবাক হল। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কেমন আছেন? মনিরা বলর, আল্লাহর রহমতে ভালাে আছি। তারপর নাজনীনকে বলল, তুমি প্লেটগুলাে নিয়ে যাও। আমি তােমার আন্টির সাথে আলাপ করব। নাজনীন চলে যাওয়ার পর ঝর্না বলল, নাজনীন বলছিল, আপনার ভাইয়ের অসুখ আরাে বেড়েছে। ওনার কি অসুখ? লিভার নষ্ট হয়ে গেছে। এখানেই অসুখটা হয়েছিল। তেমন গুরুত্ব দেয় নি। আপনারা সে সময় ট্রিটমেন্ট করাতে বলেন নি?

সাইফুল ছেলেবেলা থেকে বেপরােয়া স্বভাবের। কারাে কথা নেয় না। নিজে যা ভাবে তাই করে। আব্বা-আম্মার কথাই নেয় নি, আর আমার কথা শুনবে। সাইফুলের নাম শুনে ঝর্ণা চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, আপনার কি আরাে একটা ভাই আছে? মনিরা তাকে চমকে উঠতে দেখে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন বলুন তাে? সাইফুলই আমার একমাত্র ভাই।।

যিনি আমাকে নাজনীনকে পড়াবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, তিনি আপনার ভাইয়ের নাম আরজু বলেছিলেন। ও তাই বলুন। আমি মনে করেছিলাম, আপনি সাইফুলকে চেনেন। আরজুর আসল নাম সাইফুল। এই বাড়ি যাদের ওনাদের সাইফুলের মতাে একটা ছেলে ছিল। ছেলেটা কলেজে পড়ার সময় মারা যায়। তার নাম ছিল আরজু। সাইফুলকে পেয়ে উনি ও ওনার স্ত্রী ছেলের শােক ভুলে যান এবং সাইফুলকে নিজের ছেলে করে লেখাপড়া করান। ওনারাই সাইফুলের নাম পরিবর্তন করে নিজের ছেলের নামে ডাকতেন।

মনিরার কথা শুনে ঝর্ণার মনে অনুশােচনার ঝড় বইতে শুরু করেছে। অনেক কষ্টে সংবরণ করে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব কিছু মনে করবেন না। আপনার ভাই কি এখনাে বিয়ে করেন নি?

না। আব্বা-আম্মা কত চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কিছুতেই ও রাজি হয় নি। আপনাদের দেশের বাড়ি কোথায়? কুড়িগ্রাম জেলার অনন্তপুর গ্রামে। শুনে ঝর্ণা আবার চমকে উঠল। শিরীনের স্বামীর কাছে তার বন্ধুর হিস্ট্রী শুনে ঝর্ণা যে কথা অনুমান করে সন্দেহের দোলায় দুলছিল, মনিরার কথা শুনে নিশ্চিত হল, আরজুই সাইফুল।

একটু আগে সাইফুলের নাম শুনে অনুশােচনার যে ঝড় মনে বইত শুরু করেছিল, তা এখন প্রবল আকার ধারণ করল। চোখে পানি এসে গেছে বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে চোখ মুছে। নিজেকে সামলাবার প্রাণপণ চেষ্টা করল। তারপর মাথা তুলে জানা সত্ত্বেও অসুখ কতটা সিরিয়াস তা জানার জন্য জিজ্ঞেস করল, আপনার ভায়ের লিভার নষ্ট হল কি করে?

ঝর্ণার হাবভাব দেখে মনিরার মনে সন্দেহ হল। এখন যেন তাকে হামিদ চেয়ারম্যানের মেয়ে বলে একটু একটু মনে পড়ছে। সন্দেহটা যাচাই করার জন্য সাইফুলের সব কথা বলতে আরম্ভ করল। সে কথা আর জিজ্ঞেস করবেন না। সাইফুল। পড়তে পড়তে বিলেত চলে যায়। এই বাড়ির মালিক ও ওনার স্ত্রী মারা যাওয়ার খবর পেয়ে ফিরে এসে আমাদের সবাইকে দেশ থেকে নিয়ে আসে। আমাদের আনার পর।

গুলশানে বাড়ি করে ওখানে একা থাকত। শুধু অফিস থেকে এখানে খেতে আসত। আব্বা-আম্মা মারা যাওয়ার কিছু দিন পর একদিন আমাকে বলল, এখানে আমার। কিছুতেই মন টিকছে না। আমি আবার বিলেত চলে যাব। ওকে নিষেধ করে কোনাে ফল হবে না ভেবে কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। তারপর বেশ কয়েকদিন ওর খােজখবর নেই। অফিসে ফোন করে পাওয়া যায় না। দুপুরে এখানে খেতে আসে, তাও। আসে না।

একদিন সন্ধ্যের পর আমি গুলশানের বাড়িতে গেলাম। তখনও সে ফিরে। নি। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাত দশটার দিকে মাতাল হয়ে টলতে টলতে। ফিরল । সাইফুল মদ খাবে, তা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। প্রচণ্ড বেগে গিয়ে।

তার গালে একটা কষে চড় মেরে বললাম, তুই ধার্মিক ছেলে হয়ে মদ খাস? আল্লাহপাক মদকে হারাম করেছেন, তা ভুলে গেছিস? আমার চড় খেয়ে সাইফুলের চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে পড়ল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে মাথা নিচু করে রইল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বুবু, তুমি আমাকে যত ইচ্ছা মার আর বকাবকি কর, তাতে আমি কিছুমনে করব

মদ ধরেছি কেন শুনবে? তারপর চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, আমি হেরে গেছি বুবু। ঝর্ণা আমার সবকিছু কেড়ে নিয়ে হারিয়ে দিয়েছে। সেই পরাজয়ের গ্লানী ভলে থাকার জন্য প্রথমে দেশ ছাড়লাম, তাতে কাজ না হতে মদ ধরেছি। তবু যে। তাকে ভুলতে পারছি না বুবু। আমি ছােটবেলা থেকে যে স্বপ্ন দেখে এসেছি, তা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে। ওর কথা শুনে মনে হল, মদ খেয়ে মাতলামি করছে।

তাই আরাে রেগে গিয়ে তার দ’গালে বেশ জোরে কয়েকটা চড় মেরে বললাম, মদ খেয়ে ঘরে এসে মাতলামি করা হচ্ছে। সাইফুল মারকে গ্রাহ্য না করে আমার দু’পা জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে বলল, বুবু তুমি আমাকে আরাে মার। ঝর্ণা যে হঠাৎ বিয়ে করে ফেলবে, তা কল্পনাও করতে পারি নি। ঘুণাক্ষরে যদি বুঝতে পারতাম, তা হলে যেমন করে হােক তার বিয়ে বন্ধ। করে দিতাম। সব থেকে বড় কথা কি জান বুবু, যার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে, সে ছেলেটা ভালাে নয়।। ওর কথা শুনে মনে হল, মদ খেলেও মাতলামি করছে না। বললাম, ঝর্ণা কে?

বলল, তােমার মনে নেই বুবু, আমাদের গ্রামের হামিদ চেয়ারম্যানের মেয়ের কথা? ক্লাস টেনে পড়ার সময় তাকে চিঠি দিয়েছিলাম বলে সেই চিঠি হেডস্যারের কাছে দিয়ে আমাকে মার খাইয়েছিল? সেজন্যে আমি পড়া ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় পালিয়ে আসি। সেই ঝর্ণা ভার্সিটিতে পড়ত। তিন বছরের বেশি হয়ে গেল আমিনের সাথে তার বিয়ে হয়ে গেছে। ওকে ভুলে যাওয়ার জন্য মদ খাই। তবু যে ভুলতে পারছি না। কি করলে ওকে ভুলতে পারব, তুমি বলে দাও না বুবু। আমি যে আর পারছি না।

ওর এই পরিণতির কারণ জানতে পেরে আমারও খুব দুঃখ হল। ভাবলাম, সাইফুল ছােটবেলা থেকে ধর্মের আইন মেনে চলে। একটু বড় হতে গ্রামের কেউ। অন্যায় কিছু করে পার পেত না। মাতবররা সাইফুলকে ছাড়া বিচার করত না। গ্রামের ছােট-বড় সবাই সাইফুলকে ভালবাসত। সেই সাইফুল ঝর্ণাকে না পেয়ে মদ খাচ্ছে? বললাম, কাউকে ভালবাসা পাপ নয়। তুই ঝর্ণাকে ভালবাসিস, সেটা ভালাে কথা।

কিন্তু তাই বলে তাকে না পেয়ে আল্লাহর হুকুমের বরখেলাপ কাজ করছিস কেন? একটা। মেয়ের জন্য তাের মতাে শিক্ষিত ছেলের এটা করা উচিত হয়েছে? অনেক সময় অনেক জ্ঞানী-গুণীজনও সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শয়তানের প্ররােচনায় অন্যায় করে ফেলেন। তােরও তাই হয়েছে। তুই আমাকে যে কথা জিজ্ঞেস করলি, তার সমাধান বলছি, তুই। একটা ভালাে মেয়ে দেখে বিয়ে কর। তা হলে দেখবি, প্রথম দিকে একটু খারাপ। লাগলেও ধীরে ধীরে ঝর্ণাকে ভুলতে পারবি।।

এই কথা শােনার পর সাইফুল বলল, তাও আমি চিন্তা করে দেখেছি। কিন্তু অন্য কোনাে মেয়ের কথা ভাবলে ঝর্ণার স্মৃতি আমাকে আরাে অস্থির করে তুলে। তুমি আমাকে বিয়ের কথা বলাে না বুবু। তার চেয়ে আমার খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিও। তারপর সে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকল।

আমি তাকে সেদিন অনেক বুঝিয়ে এই বাসায় ফিরে এলাম। কিন্তু কিছুতেই মদ ছাড়ল না। বরং এরপর থেকে আরাে বেশি মদ খেতে লাগল ।
জানেন, সাইফুল ঝর্ণাকে এখনাে এত বালবাসে তা আপনাকে বলে বুঝাতে পারব না। গুলশানে যে বাড়িটা করেছে, সেটার নাম দিয়েছে ঝর্ণালজ। আর কত রং বেরং এর স্যালওয়ার, কামিজ,

ওড়না, শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ এবং কত রকমের প্রসাধনী কিনে ঘরে সাজিয়ে রেখেছে, তার ইয়ত্তা নেই। দেখলে মনে হবে সে সুখী দাম্পত্য জীবন কাটাচ্ছে। শুধু গুলশানের বাড়িতে এ সব করে নি, এখানে যে রুমে থাকত সে রুমেও ঐ সব জিনিস আছে। একদিন আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, হ্যারে তুই বিয়ে করবি না বলিস, তবে আবার এ সমস্ত জিনিস কার জন্য কিনে ঘর ভরিয়ে রেখেছিস?

তখন সাইফুল বলল, জান বুবু, ঝর্ণাকে এই সমস্ত জিনিস ব্যবহার করতে দেখেছি। তাই কিনে রেখেছি। তার পছন্দ মতাে জিনিস দেখে আমি মনে খুব শান্তি পাই। আলমারীতে ও ওয়ার্ডড্রবে যে কত জামা-কাপড় কিনে রেখেছে, তা যদি দেখতেন, তা হলে আপনি তাকে পাগল ছাড়া আর কিছু ভাবতেন না।

ঝর্ণা মনিরার মুখে তার প্রতি সাইফুলের ভালবাসার কথা শুনতে শুনতে বাস্তব জ্ঞান। হারিয়ে ফেলল। বারবার তার মনে হতে লাগল, যে সাইফুলকে স্কুল জীবন থেকে সব থেকে বেশি ঘৃণা করে এসেছে, সেই সাইফুল তাকে এত ভালবাসে? এই দুনিয়ায় কোনাে ছেলে কি কোনাে মেয়েকে এত বালবাসতে পারে? তার তখন মনে হল, সাইফুলের মনে এত কষ্ট দিয়েছি বলে আল্লাহ আমার অবস্থা এইরকম করলেন।

এখন সাইফুল যদি জানতে পারে, আমিনের সঙ্গে আমার ডির্ভোস হয়ে গেছে, আমি তার অফিসে চাকরি করছি এবং তার ভাগ্নিকে পড়াচ্ছি, তা হলে কি করবে? আমাকে সে কি গ্রহণ করবে? আর সে গ্রহণ করতে চাইলে আমি কোন মুখে তা স্বীকার করব? তৎক্ষণাৎ ঝর্ণার বিয়ের পরে সাইফুল যে কথা একদিন বলে এসেছিল, তা মনে পড়ল- তােমার বিয়ে হয়ে গেছে জেনেও আজীবন তােমার অপেক্ষায় থাকব। তােমাকে না পেলেও যতদিন বাঁচব ততদিন তােমার স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকব।'

অনুশােচনায় ঝর্ণার অন্তর ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। সে চেয়ারে সােজা হয়ে বসে থাকতে পারল না। নিচু হয়ে হাতের উপর মাথা ঠেকিয়ে সামলাবার চেষ্টা করল।। মনিরা কথা বলতে বলতে ঝর্ণার মুখের অবস্থা মাঝে মাঝে করুণ হতে দেখেছে। এখন তাকে ঐভাবে থাকতে দেখে সন্দেহটা দৃঢ় হল। ভাবল, মেয়েটাকে প্রথম দিন দেখে চেনা চেনা লেগেছিল। আজ আবার সাইফুলের কথা শুনে এরকম করছে কেন? তা হলে কি এই ঝর্ণা? নাম জিজ্ঞেস করব না কি? আবার ভাবল, তা কি করে হয়? তার তাে বিয়ে হয়ে গেছে। হয়তাে ওনার প্রেসার আছে। সাইফুলের কথা শুনে দুঃখ পেয়ে প্রেসারের গােলমাল শুরু হয়েছে। জিজ্ঞেস করল, আপনি কি অসুস্থ বােধ করছেন?

ঝর্ণা আরাে কিছুক্ষণ ঐভাবে থেকে সামলে নিয়ে সােজা হয়ে বসে বলল, হ্যা, মানে হঠাৎ মাথাটা যেন ঘুরে গেল। তারপর দাড়িয়ে বলল, আজ আসি আপা।। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যান। মাথা ঘুরছে বললেন না? এখন একটু সুস্থ বােধ করছি। আসি বলে সালাম বিনিময়ে করে চলে গেল। মনিরার মনে সন্দেহটা থেকেই গেল। ভেবে রাখল, কয়েকদিন যাক, তারপর চালাকি করে ওর পরিচয় জিজ্ঞেস করলে সব কিছু জানা যাবে।।

বাসায় ফিরে ঝর্ণা সাইফুলকে নিয়ে অনেক চিন্তা করল। তার কথা যত ভাবে তত চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। চিন্তায় চিন্তায় দু'দিন অফিসেও গেল না এবং নাজনীনকে পড়াতেও গেল না।

প্রথম দিন শিরীন ঝর্ণার শুকনাে বেদনাভরা মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কিরে তাের অসুখবিসুখ করেছে নাকি? তােকে ঐরকম দেখাচ্ছে কেন? তার উত্তরে ঝর্ণা বলেছিল, মাথা যেন কেমন করছে। তারপর তাকে দু’দিন ঘরে থাকতে দেখে দুপুরে খাওয়ার পর বলল, তাের কি হয়েছে বলতাে? ভালাে করে খাচ্ছিস না, অফিস কামাই করছিস, ছাত্রী পড়াতেও যাচ্ছিস না। অসুখবিসুখ হলে কোনাে ডাক্তারের কাছে যা। তারপর স্বামীর কথা বলে বলল, তাকেও তাে বলতে পারিস? অসুখবিসুখ কিছু হলে তাই করতাম।

তা হলে কি হয়েছে বলবি তাে? তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বলল, তা যদি না হয়, তবে কি কোনাে প্রবলেমে পড়েছিস? এই কথা বলার পরও ঝর্ণার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে গায়ে একটা হাত রেখে বলল, যদি কোনাে প্রবলেমে পড়ে থাকিস, তা হলে বল, সেটা সলভ করার চেষ্টা করব। ঝর্ণা শিরীনের দিকে তাকিয়ে কি ভাবে সাইফুলের কথা বলবে, চিন্তা করতে করতে তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।

শিরীন তাই দেখে আতঙ্কিত হয়ে বলল, কিরে আমিন তাের খোঁজ পেয়ে। শাসিয়েছে না কি? আমিনের সঙ্গে মাস ছয়েক আগে ডিভাের্স হয়ে গেছে। ঝর্ণা না বলে বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। | শিরীন কিছু বুঝতে না পেরে বেশ অবাক হয়ে বলল, কি হয়েছে বল না? আমাকে বলতে তাের বাধা কোথায়? তুই কি আমাকে বিশ্বাস করিস না? ঝর্ণা সংযত হয়ে বলল, তুই যা ভাবছিস, সে সব কিছু নয়।

ব্যাপারটা খুব দুঃখজনক। আর সেটার জন্য আমিই দায়ী। আমার ভাগ্যে বুঝি কোনাে দিন সুখশান্তি আসবে না। চিরকাল দুঃখের সাগরে ভেসে বেড়াতে হবে।

শিরীন বলল, সুখ-দুঃখ নিয়েই মানুষের জীবন। আমিনের সঙ্গে দৈব দুর্ঘটনায় যা। হয়েছিল, ডিভাের্সের মধ্যে দিয়ে তার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। তুই ইচ্ছা করলে তাের বাবা-মার কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকে জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারিস। তারপর ওনারা আবার ভালাে ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে সুখী করার চেষ্টা করবেন।

ঝর্ণা মলিন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, মানুষ যা ভাবে তা যদি হত, তা হলে পথিবীতে দুঃখ বলে কিছু থাকত না। বাবা-মার কাছে কিছুতেই আমি ফিরে যেতে পারব না। নিজের কথা চিন্তা করে আমার এই অবস্থা হয় নি। আমার এই অবস্থা কেন, হয়েছে বললে, তুই যেমন অবাক হবি তেমনি দুঃখও পাবি। শিরীন বলল, আমার যাই হােক না কেন, তুই বল ।

ঝর্ণা তখন সেই স্কুল জীবন থেকে গত দু'দিন আগে পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে সব। খুলে বলল। | শিরীন শুনে সত্যি সত্যি যেমন অবাক হল তেমনি দুঃখও পেল। বলল, এরকম। একতরফা প্রেম কাহিনী কখনাে শুনি নি। তুই কি করবি ভেবে কিছু ঠিক করতে পেরেছিস? না, এখনাে ভেবে কিছু সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারি নি। তুই বল না, আমার কি করা উচিত? চাকরি ছেড়ে দেব?

free bangla love story

bangla love story

আমার কথা যদি মেনে নিস, তা হলে বলব, সাইফুলের এই পরিণতির জন্য যখন তুই দায়ী তখন তাকে বাঁচানাের জন্য তােরই এগিয়ে যাওয়া উচিত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তােকে সে ফিরিয়ে দেবে না। বিয়ের পর তােক তাে বলেছিল, তাের জন্য সে চিরকাল। অপেক্ষা করবে। তাের জন্যে চিরকাল তার মনের দুয়ার খােলা থাকবে। আর এখন চাকরি ছাড়িস না। সেটা যখন ইচ্ছা ছাড়তে পারবি।

আরাে ভাবনাচিন্তা করে দেখ। আমার মনও তাই বলে। কিন্তু আমি কোন মুখে তার কাছে গিয়ে দাড়াব । কি বলে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে বলব, আমার ভুল ভেঙ্গেছে, এখন তােমার মতাে আমিও তােমাকে ভালবাসি? এত নিলজ্জ হব কি করে?

এত চিন্তা করছিস কেন? তুই তাে বললি, বিলেতে সে অসুখে ভুগছে। তাের। ছাত্রীর কাছ থেকে তার ঠিকানা নিয়ে সাইফুলকে চিঠিতে তাের বর্তমান অবস্থার কথা। জানা। উত্তরে কি বলে দেখ। তারপর যা কিছু করার করবি। সে কঠিন অসুখে ভুগছে। কঠিন অসুখের সময় সব মানুষই অতি প্রিয়জনকে পেলে বাঁচার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠে। আমার মনে হয়, চিঠি পেয়ে সে নিজেই তাের কাছে ছুটে আসবে।

এখন আমার কথা শােন, ভেঙ্গে না পড়ে মনকে শক্ত করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চা। আর কাজকর্ম ঠিকমত করে যা। সাইফুলকে চিঠি দিয়ে অপেক্ষা কর। ততদিন তুইও চিন্তা কর, কিভাবে তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করবি।

তুই অবশ্য ভালাে কথাই বলেছিস ; কিন্তু আমি কিভাবে কি করবাে চিন্তা করে ঠিক করতে পারছি না। একটা কথা বুঝতে পারছিস না কেন? সাইফুলের সবকিছু জেনে তাের মনে বে। অনুশােচনার ঝড় বইছে, তার কারণ তুইও এখন তাকে ভালবেসে ফেলেছিস? আল্লাহ। না করুক, সত্যি সত্যি তার যদি কিছু হয়ে যায়, তা হলে তুই নিজেকে কি বলে বােধ। দিবি? তখন আর অনুশােচনা করেও কোনাে ফল হবে না।

এখনও সময় আছে, যা বললাম তাই কর। তারপর তাের ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। একখাটা কথা জেনে রাখ, প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিজেদের মধ্যে ক্ষমা চাওয়া-চাউয়ি করতে দ্বিধা থাকা উচিত।

আর একটা জিনিস তাের বােঝা উচিত, তুই তাকে এখন ভালবাসিস বলে। কাঁদছিস, নচেৎ তার এই পরিণতি দেখে তাের তাে আনন্দ পাওয়ার কথা। ঝর্ণা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, তুই ঠিক বলেছিস। তাের কথামতাে আগে। • একটা চিঠি দেব; তারপর আমার তকৃদির আমাকে দিয়ে যা করাবে তাই করব।। পরের দিন ঝর্ণা সকলীভের দরখাস্ত লিখে নিয়ে অফিসে গেল। ফেরার পথে। নাজনীনকে পড়াতে গিয়ে জানল, তার আম্মা মীরপুর মাজারে গেছে।

আজ ঝর্ণার কেবল সাইফুলের কথা মনে পড়তে লাগল। এক সময় নাজনীনকে জিজ্ঞেস করল, তােমার মামাকে চিঠি দিয়েছ? হ্যা দিয়েছি। সেই সঙ্গে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার জন্য টেলেক্সও করেছি। তােমার মামার ঠিকানাটা একটা কাগজে লিখে দাওতাে। নাজনীন টেবিলের ড্রয়ার খুলে মামার চিঠিটা বের করে খাতার পাতায় ঠিকানা। লিখে পাতাটা ছিড়ে আন্টির হাতে দিল ।

ঝর্ণা ঠিকানাটায় একবার চোখ বুলিয়ে ভাজ করে ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে বলল, আজ পড়াতে ভালাে লাগছে না, তােমাদের বাসাটা একটু ঘুরে দেখি চল ।।

নাজনীন আন্টিকে সঙ্গে করে সব ঘর দেখিয়ে দোতালায় মামার রুমে নিয়ে গেল।
দরজা খুলে ঢুকে ঝর্ণা রুমের চারদিকে একবার তাকিয়ে আশ্চার্য হয়ে স্থানুবৎ দাড়িয়ে পড়ল । কি সুন্দর ভাবে সাজান রুমটা। এক সাইডে ডবল বেডের খাট। ঝর্ণার মনে হল সাইফুল ছাড়া আর কেউ এই খাটে ঘুমায় না। সে দীর্ঘ দিন নেই, তবু যেন কেউ প্রতিদিন বিছানাটা ঝেড়ে ঠিকঠাক করে রেখেছে। অন্য তিন সাইডে আলমারী,

বুক কেস, ওয়ার্ডড্রব ও ড্রেসিং টেবিল রয়েছে। সেগুলাে যে প্রতিদিন ঝাড়ামুছা করা হয় তা বুঝতে পারল। ডেসিং টেবিলের ছােট থাকগুলাে টানা গ্লাস সিস্টেম। থাকগুলােতে কত রকমের দেশীবিদেশী প্রসাধনী। সেগুলাের প্রায় সব ঝর্ণার পছন্দ। টেবিলের উপর সাইফুলের চারটে ফটো পাশাপাশি দাড় করান রয়েছে।

একটা স্কুলে পড়ার সময়কার, একগাদা বই হাতে। করে তােলা। দ্বিতীয়টায় সাইফুল লুংগী ও গেঞ্জী পরে রিক্সা চালাচ্ছে। তৃতীয়টা ভার্সিটির আর্টস বিল্ডিংয়ের সামনে সে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। চতুর্থটা একজনকে কুংফু শেখাচ্ছে। ফটোতে সাইফুলকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে দেখে ঝর্ণা ভাবল, তাকে দেখলে ঘৃণা হত বলে তার এই সুন্দর চেহারা এতদিন লক্ষ্য করে নি। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে।

 আরাে আশ্চর্য হয়ে গেল। চারপাশের দেওয়ালে চারটে বড় অয়েল পেন্টিং রয়েছে। প্রত্যেকটাতে পাহাড়ী ঝর্ণার দৃশ্য। আর প্রত্যেকটার নিচে আলাদা কাগজে কিছু হাতে লিখে গাম দিয়ে সেঁটে দেয়া হয়েছে। ঝর্ণা এগিয়ে গিয়ে পড়তে লাগল। | (১) ঝর্ণা, তুমি এই পাহাড়ী ঝর্ণার মত চঞ্চল। তােমার চঞ্চলতা আমাকে বড় মুগ্ধ
(২) ঝর্ণা, তুমি ঝর্ণার মত সর্বদা আমার হৃদয়ে বয়ে চলেছ। যার শব্দ আমি অহরহ শুনে তৃপ্তি পাই।

(৩) ঝর্ণা, তুমি আমার জীবনের স্বপ্ন। তােমাকে নিয়ে এই রকম ঝর্ণার পাশে দাঁড়িয়ে বলব, সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব সৃষ্টি এই ঝর্ণার চেয়ে শত শত গুণ বেশি সুন্দরী তুমি; তােমাকে আমি আমার সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে ভালবাসি।'

(৪) ঝর্ণা, তােমাকে পাব কিনা জানি না, তবে চিরকাল তােমার স্মৃতি এই ঝর্ণার স্রোতের মতাে আমার হৃদয়ের শিরা উপশীরায় রক্তের সঙ্গে আমৃত্যু বইতে থাকবে। লেখাগুলাে পড়ে ঝর্ণার মাথা ঘুরতে লাগল। কোনাে রকমে টলতে টলতে টেবিলের কাছে এসে সাইফুলের ফটোগুলােতে একবার হাত বুলিয়ে মুচ্ছা যেয়ে মেঝেয় পড়ে গেল।

নাজনীন আন্টিকে আসা অব্দি তার মন খারাপ দেখেছে এবং এই ঘরে ঢােকার পর থেকে তার মুখের চেহারা আরাে খারাপ হতে লক্ষ্য করেছে। এখন পড়ে যেতে তাড়াতাড়ি তার কাছে এসে বসে কয়েকবার আন্টি বলে ডাকল। সাড়া না পেয়ে দু’জন। কাজের মেয়েকে ডেকে ধরাধরি করে মামার খাটে শুইয়ে দিল। তাদের একজনকে চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিতে বলে সে ফ্যান ছেড়ে দিল।

কিছুক্ষণের মধ্যে ঝর্ণার জ্ঞান ফিরল।
নাজনীন আন্টিকে চোখ খুলতে দেখে ভয়ার্তস্বরে জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন বােধ করছেন? ঝর্ণা জ্ঞান ফিরে পেয়ে সাইফুলের খাটে নিজেকে শুয়ে থাকতে দেখে হৃদয়ে যেন কি রকম একটা শান্তি অনুভব করল । ভাবল, আল্লাহ কি আমাকে আবার এই বিছানায় শােবার ভাগ্য করবেন? নাজনীনের কথাশুনে উঠে বসে বলল, মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠতে

পড়ে গেলাম। এখন ভালাে লাগছে। চল, আমরা এ ঘর থেকে যাই। বেরিয়ে আসা সময় চিন্তা করল, ছি ছি, নাজনীন কি ভাবছে কি জানি।। | নিজের রুমে এসে নাজনীন বলল, আপনি আরাে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। আমি আসছি বলে সে বেরিয়ে গেল।

ততক্ষণ মনিরা ফিরেছে। মেয়ের মুখে ঝর্ণার কথা শুনে তাড়াতাড়ি এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, এটা খেয়ে নিন, সুস্থ বােধ করবেন। ঝর্ণা দুধটা খেয়ে প্রসঙ্গ এড়াবার জন্য বলল, নাজনীনের কাছে শুনলাম, আপনি মাজারে গিয়েছিলেন? মনিরা বলল, হ্যা। সাইফুল যাতে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে এবং তার সুস্থ্যতার জন্য মীরপুরের ও হাইকোর্টের মাজারে মানত করে এলাম।

ঝর্ণা বলল, হাদিসে পড়েছি, কোনাে অলি আল্লাহর মাজার জিয়ারত করা যায়েজ হলেও সেখানে মানত করা, আগরবাতি এবং টাকা-পয়সা দেয়া নাযায়েজ। হাদিসে আছে, আল্লাহর রাসূল (দঃ) বলিয়াছেন, “তােমাদের কারাে কিছু চাওয়ার দরকার হলে সরাসরি আল্লাহপাকের কাছে চাইবে। তিনি সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। তাঁর ইচ্ছা। ব্যতিরেকে কেউ কিছু করতে পারে না।' | মনিরা বলল, আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। আমি না জেনে করে ফেলেছি। আর কখনাে এমন কাজ করব না।

ঝর্ণা তারপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এল। ঝর্ণা চলে যাওয়ার পর মনিরা মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, তাের আন্টি সাইফুলের ঘরে গেল কি করে? নাজনীন বলল, আজ আসার পর থেকে আন্টির মনটা খারাপ দেখলাম। পড়াতে ভালাে লাগছে না বলে আমাদের বাসাটা ঘুরে দেখতে চাইলেন।

সব ঘর দেখার পর মামার ঘরে ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে কেমন যেন হয়ে গেলেন। তারপর মামার ফটোতে একবার হাত বুলিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। আমার কি মনে হয় জান আম্মা, আন্টি বােধ হয় সেই মেয়ে, যাকে মামা ভালবাসে। মনিরাও তাই আন্দাজ করেছে। তবু জিজ্ঞেস করল, কি করে বুঝলি?

নাজনীন এখন কলেজে পড়ছে। সব কিছু বুঝবার বয়সও হয়েছে। মায়ের কথা শুনে বলল, আজকের ঘটনা থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। তা ছাড়া মামার কথা আন্টি। প্রায় জিজ্ঞেস করে। তাের আন্টির নাম জানিস? ঝর্ণা। তাতেই তাে আমার ধারণা দৃঢ় হয়েছে।

মনিরা মেয়ের কথা শুনে চমকে উঠে ভাবল, তা হলে কি স্বামীর সঙ্গে ঝর্ণর। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে? দু'দিন আগে সাইফুলের কথা শােনার পর ঝর্ণার হাবভাব লক্ষ্য। করে যে সন্দেহ হয়েছিল, আজকের ঘটনা শুনে সেই সন্দেহ আরাে দৃঢ় হল। ভেবে রাখল, ঝর্ণাকে এখন কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না। সাইফুল ফিরে এলে সত্যি-মিথ্যা যাচাই করে যা হয় করা যাবে।।

নাজনীনকে বলল, তুই তাের আন্টির সঙ্গে এমন ব্যবহার করবি, যেন তুই তার আসল পরিচয় জানিস না। ঐদিন বাসায় ফিরে এলে শিরীন তার মুখের করুণ অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করল, কিরে, তাের কি হয়েছে? তাের মুখ অত শুকনাে কেন? | ঝর্ণা ছলছল চোখে আজকের ঘটনা বলে বলল, জানিস, আমি সাইফুলকে যত জানতে পারছি তত ওকে ভালবেসে ফেলছি। ওর ভালবাসার গভীরত্বের কোনাে তল। পাচ্ছি না। সে কথা মনে হলে আমার অন্তরটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।।

শিরীন বলল, আল্লাহ তােকে সহ্য করার ক্ষমতা দিক। তুই কি সাইফুলকে চিঠি। দিয়েছিস? ঠিকানা জানতাম না। আজ নাজনীনের কাছ থেকে এনেছি। আজ চিঠিটা রাতে লিখে কাল পােষ্ট করে দিবি। রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর ঝর্ণা কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসল। পত্রের প্রারম্ভে তােমাকে কি বলে সম্বােধন করব, তা ঠিক করতে না পেরে জায়গাটা ফাঁকা রাখলাম। আমি তােমাকে পত্র দেব, এটা যেমন তুমি ভাবতে পারছ না, তেমনি আমিও কোনাে দিন ভাবি নি।

কিন্তু মানুষ নিয়তির কাছে বন্দি। নিয়তি কখন মানুষকে দিয়ে কি করাবে তা কেউ জানে না। আমিও মানুষ। তাই আমাকে নিয়ে নিয়তি যে খেলা খেলে চলেছে তা সহ্য করতে পারছি না। স্কুল জীবন থেকে তুমি আমাকে যত না ভালবেসেছ, তার চেয়ে অনেক বেশি আমি তােমাকে ঘৃণা করেছি।

তুমি আমাকে চিনলেও আমি চিনি নি। আমিনের কপট ভালবাসায় পড়ে তােমাকে জব্দ করার জন্য তার ফাঁদে পা দিই। বিয়ের মাস খানেক পর তার আসল রূপ দেখে ভয়ে শিউরে উঠি। কিন্তু তখন আমার আর কিছু করার উপায় ছিল না বলে, ভাগ্যকে মেনে নিয়ে সামাল দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু ভাগ্য আমার প্রতি বিরূপ। তাই দুটো বছর আমিনের অকথ্য অত্যাচার সহ্য করে যখন সহ্যের বাইরে চলে গেল তখন পালিয়ে এসে এই ঠিকানায় এক বান্ধবীর বাসায় উঠি।

বান্ধবীর স্বামী ডিভাের্সের ব্যবস্থা করে দেন। তারপর ওনারই চেষ্টায় চাকরি করে ওনাদের কাছে আছি। ওনাদের কাছে। থাকতে কিতে আল্লাহপাক তার অপার করুনায় আমাকে হেদায়েৎ দান করে একদিকে যেমন ধন্য করেছেন, তেমনি তােমার সবকিছু জানিয়ে আমাকে দুঃখের ও অনুশােচনার সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন।

তুমি আমার বিয়ের পর আমাকে যে কথা বলেছিলে, সেই কথার উপর ভসা করে এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে এই চিঠি লিখলাম। আমার জন্য তােমার এই পরিণতি হয়েছে জানতে পেরে পুরানা পল্টনের বাড়িতে তােমার রুমে একদিন গিয়ে যা দেখলাম, তাতে করে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

তােমার কাছে ক্ষমা চাইতে সাহস হচ্ছে না। কারণ যদি তুমি আমাকে ক্ষমা করে কাছে পেতে চাও, তা হলে কোন মুখে, কেমন করে এই অপবিত্র দেহ নিয়ে তােমার সামনে দাঁড়াব? আমার কারণে তুমি চিরকুমার থাকবে এবং আমার স্মৃতির যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মদ খেয়ে লিভার পচিয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছ জানতে পেরে আমার অন্তর অনুশােচনার আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। জানি না কতদিন এই

আগুন সহ্য করতে পারব। বেশি কিছু লিখে তােমার ক্ষত বিক্ষত হৃদয়কে আরাে ক্ষত বিক্ষত করতে চাই না। শুধু আর একটা কথা বলে শেষ করছি, ঘৃণা করে জব্দ করতে গিয়ে তােমাকে যতটা শাস্তি দিয়েছি, আল্লাহপাক তার শতশতগুণ বেশি দৈহিক ও মানসিক শান্তি আমাকে দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন।

তােমার ভালবাসার কসম দিয়ে বলছি তুমি আমাকে যা শাস্তি দিয়ে তপ্তি পাও তাই দিও, তবু মদ ছেড়ে দাও এবং যত শিদ পার দেশে ফিরে এস। আল্লাহর কাছে তােমার সহিসালামতের এবং তােমাকে হেদায়েৎ করে দেয়ার জন্য দোয়া করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ। ইতি তােমার ভালবাসার পাত্রী।

অপবিত্রা ঃ ঝর্ণা। পরের দিন অফিসে যাওয়ার পথে চিঠিটা পােষ্ট করল। বিকেলে নাজনীনকে। পড়াতেও গেল।। নাজনীনের মায়ের কথামত এমনভাবে আন্টির সঙ্গে ব্যবহার করল, যেন। গতকালের ঘটনা সে জানে না।। নাজনীনের ব্যবহার দেখে ঝর্ণা স্বস্থি পেল ।

তবু ভাবল, গতকালের ঘটনায় এরা কি তা হলে কিছু বুঝতে পারে নি? চিন্তাটা দূর করে দিয়ে নাজনীনকে ভালভাবে পড়াতে লাগল। অসস ৰিম আ ৰু মাস তিনেক পর একদিন পড়ার সময় নাজনীন ঝর্ণাকে বলল, জানেন আন্টি, আগামীকাল মামা আসছে। কথাটা বলে সে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তার। চেহারার কোনাে পরিবর্তন হয় কি না দেখার জন্য।

কথাটা শুনে ঝর্ণার মুখটা মুহুর্তের জন্য আনন্দোজ্জল হয়ে পরক্ষণে গভীর চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল। যে পড়াটা বােঝাচ্ছিল সেটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। নাজনীন যা বােঝার বুঝে গেল। বলল, আন্টি চুপ করে আছেন কেন? শরীর। খারাপ লাগলে আজ পড়া বন্ধ থাক।। ঝর্ণা নাজনীনের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, না, তেমন কিছু হয় নি, তুমি পড়।। পরের দিন ঝর্ণা অফিসে গিয়ে শুনল, আজ এগারটার ফ্লাইটে সাহেব আসছেন। তিনি অসুস্থ। তাই ছুটির পর অফিসের সব স্টাফ সাহেবকে দেখতে বাসায় যাবে।।

ঝর্ণা চিন্তা করতে লাগল সেও যাবে কিনা। এক মন বলল, তাের চিঠির উত্তর দেয় নি। তাতেই বুঝতে পারছিস না কেন, সে তােকে গ্রহণ করবে না। তাের যাওয়া উচিত না। আর এক মন বলল, যদি না যাস, তা হলে অফিস স্টাফরা তােকে কি ভাববে, সে সে কথা ভেবে দেখ। তুইতাে বােরখা পরে যাবি, তােকে সে চিনতে পারবে না। সবাইয়ের সঙ্গে তাের যাওয়া উচিত। গিয়েই দেখ না কি ঘটে?

মনিরা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি করে এয়ারপাের্টে গেল। সাইফুলকে দেখে তারা। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। সে খুব রােগা হয়ে গেছে। চোখ-মুখ বসে যাওয়ায় তাকে চেনাই যায় না। সাইফুল তাদেরকে প্রবােধ দিতে দিতে গাড়িতে উঠল।

বুবু ও ভাগ্নির শত আকুতি-মিনতি স্বত্তেও সাইফুল পুরানা পল্টনের বাড়িতে না উঠে গুলশানের বাড়িতে উঠল। সেই বাড়ি দেখাশুনার জন্য দু'জন কাজের লােক ও একজন দারােয়ান সাইফুল রেখে গিয়েছিল।

দারােয়ান সাহেবের গাড়ি দেখে গেট খুলে দিয়ে সালাম দিল। কাজের লােক দুটো। বাসার সামনের ফাঁকা জায়গায় কি কাজ করছিল, তারাও এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে। গাড়ির পিছন পিছন এল।। খাওয়া-দাওয়ার পর মনিরা সাইফুলকে তার অসুখের ও চিকিৎসা করার কথা জিজ্ঞেস করল।
সাইফুল বলল, সেখানে অনেক চিকিৎসা করিয়েছি। ডাক্তাররা বলেছে, আগে মদ। ছাড়তে হবে তারপর লিভার যতটা নষ্ট হয়েছে, তা কেটে বাদ দিতে হবে। তবে এটা খুব রিস্কি। বাচতে পারি নাও পারি। কোনােটাই হয় নি।

মনিরা বলল, আমি এখানকার বড় বড় ডাক্তারদের নিয়ে বাের্ড তৈরি করে তাের চিকিৎসা করাব। সাইফুল স্লান হেসে বলল, করার সময় পার হয়ে গেছে। তা ছাড়া সেখানকার ডাক্তাররা যা পারে নি, তখন আর এখানকার ডাক্তাররা কি পারবে? এদের দৌড় কত, তা আমার জানা আছে। তুই সারা জীবন নিজের গয়ে চলেছিস। এখন আর সেই গয়ে কি করে চলিস। দেখব। আমার মনে যা আছে তা করবই।

সাইফুল আর কিছু না বলে চুপ করে রইল ।। মনিরা সাইফুলকে বিশ্রাম করতে বলে নাজনীনকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সাইফল শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল, ঝর্ণা পুরানা পল্টনের বাড়িতে গিয়েছিল চিঠিতে লিখেছে। সে আমার ঐ বাড়ির খোঁজ পেল কি করে? চিঠিতে যে ঠিকানা। দিয়েছিল, সেটা তাে বন্ধু জায়েদের। জায়েদকে একবার ফোন করতে হবে। সেখানে এখনাে আছে কিনা? যদি না থাকে, তা হলে তার খোজ পাব কি করে? ঐ বাড়িতে।

এসেছিল যখন, তখন নিশ্চয় তাকে বুবু ও নাজনীন চেনে। বুবুকে তাে তার কথা জিজ্ঞেস করতে পারব না, নাজনীনকে জিজ্ঞেস করতে হবে। এইসব ভাবতে ভাবতে মদ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। বুবুর চিঠি ও টেলেক্স পেয়ে সাইফুল ফিরে আসে নি। ঝর্ণার। চিঠি পেয়ে এসেছে। সেই সময় বেশি অসুস্থ থাকায় আসতে দেরি হয়েছে।

বিকেল চারটের সময় নাজনীনের ডাকে সাইফুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল।। নাজনীন বলল, অফিসের সব লােকজন তােমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ওনারা ড্রইংরুমে অক্ষো করছেন।

সাইফুল বলর, তুই যা, আমি তৈরি হয়ে আসছি।
নাজনীন ফিরে গিয়ে আম্মাকে অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে বলে তাকে সাহায্য করার জন্য তার কাছে রইল। নাজনীন তখন ভাবছে, আন্টিও এসেছে দেখলাম। আন্টিকে দেখে মামা কি করবেন এবং মামাকে দেখে আন্টি কি করবেন কি জানি।।

কিছুক্ষণের মধ্যে সাইফুল ড্রইংরুমে এল। | তাকে দেখে অফিস স্টাফরা দাঁড়িয়ে সালাম দিল। সাইফুল সালামের উত্তর দিয়ে সবাইকে বসতে বলে নিজেও বসল। তাকে দেখে সকলের চোখে পানি এসে গেল। তাই দেখে সাইফুল তাদেরকে প্রবােধ দিয়ে ভালাে-মন্দ জিজ্ঞেস করল। তারপর আপ্যায়নের পর সবাইকে বিদায় দিল।।

ঝর্ণা সকলের সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে হতবাক হয়ে গেছে। অনেকখানি জায়গার মাঝখানে খুব সুন্দর মডেলের দোতলা বাড়ি। গেটের উপরে বড় বড় অক্ষরে ঝর্ণালজ’ লেখা। তার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সকলের পিছনে এসে ড্রইংরুমের এক কোণের দিকে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সাইফুলকে দেখছিল। তার চেহারার অবস্থা দেখে ঝর্ণা চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছিল। বােরখা পরা ছিল বলে কেউ তা দেখতে পায় নি।

সাইফুল বােরখা পরা ঝর্ণাকে দেখেছে। প্রথমে সে মনে করেছিল, বুবুর জানাশােনা কোনাে পর্দানশীন মহিলা তাকে দেখতে এসছে। সকলে চলে যাওয়ার পরও মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কে আপনি? এতক্ষণ দাড়িয়ে রয়েছেন কেন? বসুন। তবু তাকে চুপ করে সেই অবস্থায় থাকতে দেখে সাইফুল দাড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের রুমে চলে গেল।

নাজনীন কিছুক্ষণ আগে এসে দরজার পর্দা ফাক করে সব কিছু দেখছিল। মামাকে আসতে দেখে সরে গেল। মামা চলে যাওয়ার পর ড্রইংরুমে ঢুকে ঝর্ণার কাছে এসে বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। তারপর জিজ্ঞেস করল, মামার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে?
সাইফুল যখন ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল তখন সে শত চেষ্টা করেও কথা বলতে পারে নি। কে যেন তার গলা চেপে ধরেছিল। শুধু চোখের পানি অবিরল ধারায় পড়ছিল। সাইফুল চলে যাওয়ার পরও তার চোখ থেকে পানি পড়ছে।

নাজনীনের কথা শুনে সামলে নিয়ে চোখের পানি মুছে বলল, না।
আমাকে তােমার মামার রুমে নিয়ে চল, পরিচয় করব। নাজনীন আসুন বলে তাকে নিয়ে এসে মামার রুমের দরজার বাইরে দাঁড়াতে বলে সে ভিতরে গিয়ে মামাকে বলল, আমাকে পড়াবার জন্য যাকে তুমি ঠিক করে দিয়ে। গিয়েছিলে, তিনি তােমার সঙ্গে পরিচয় করতে এসেছেন।।

সাইফুল বলল, এখানে নিয়ে আয়। নাজনীন দরজার পর্দা ফাক করে বলল, আন্টি ভিতরে আসুন। ঝর্ণা ভিতরে আসার পর নাজনীন বেরিয়ে এসে দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল।।
সাইফুল তাকে দেখে বুঝতে পারল, ড্রইংরুমের সেই মেয়েটি। বলল, ড্রইংরুমে আপনার পরিচয় জানতে চাইলাম, বললেন না কেন? চেয়ারের দিকে হাত বাড়িয়ে। বলল, বসুন।

ঝর্ণা নিজেকে সামলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করল ।
কি করবে বা কি বলবে ভেবে ঠিক করতে পারল না। তার শরীর কাপতে লাগল।

তাকে চুপ করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সাইফুল আবার বলল, পরিচয় করতে এসে। কথা বলবেন না তাে এসেছেন কেন? ঝর্ণা কোনাে রকমে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে মুখের নেকাব সরিয়ে দিয়ে বলল, সাইফুল, তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পার না? নাজনীনকে পড়াতে এসে তােমার পরিচয় জানার পর থেকে অনুশােচনার আগুনে পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছি।

আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। কথা শেষ করে সে তার পায়ে দু'হাত রেখে বলল, বল, আমাকে তুমি ক্ষমা করেছ? তারপর সে সামলাতে পারল না, ফুপিয়ে কেঁদে উঠল।
ঝর্ণা মুখের নেকাব সরাতে সাইফুল তাকে চিন্তে পেরে প্রথমে চমকে উঠেছিল। এখন তার কথা ও কার্যকলাপ দেখেশুনে খুব অবাক না হলেও আনন্দে তার মন ভরে উঠল। বিলেতে ঝর্ণার চিঠি পাওয়ার পর সে যেন নবজন্ম লাভ করে।

ভেবেছে, সত্যি সাত্য ঝণা কি এই চিঠি দিয়েছে? এখন তার এহেন ব্যবহারে নিশ্চিত হয়ে হাত ধরে। তুলে ভিজে গলায় বলল, এতদিন পর আমার শেষ সময়ে তুমি কেন এলে ঝর্ণ? তােমাকে পাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে দেখে ভেবে ঠিক করলাম, তােমার স্মৃতি নিয়ে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেব। ভাগ্যের লিখন একেই বলে। তুমি ক্ষমা চাইছ কেন? আমার ঝর্ণার অন্যায় কখনাে চোখে পড়ে নি

আমি সর্বদা তার সুখ শান্তি কামনা করে। এসেছি। তাইতাে তার শত অন্যায় অপরের চোখে ধরা পড়লেও আমার চোখে পড়ে নি। আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে যত আনন্দ পেয়েছ, আমিও তার থেকে কম পাই নি। তাইতাে তােমার অন্যায়গুলাে আমার কাছে অমৃতের মতাে মনে হয়েছে। তাকে কাদতে দেখে বলল, তুমি কেঁদ না। তােমার কান্না আমি সহ্য করতে পারছি না।

love story bangla books

love story bangla books

তােমার সুখ ও শান্তির জন্য আমি আমার সমস্ত কামনা-বাসনা ত্যাগ করে বিদেশ চলে গিয়েছিলাম। সেই একই কারণে তােমার চিঠি পেয়ে ফিরে এসেছি। প্লীজ ঝর্ণা দে না। হাত জোড় করে বলছি কেঁদ না। আমি তােমাকে স্কুল জীবন থেকে অনেক বিরক্ত করেছি সেজন্য ক্ষমা চাইছি। আবার বলছি, তুমি কেঁদ না। যদি কান্না থামাতে না পার, তা হলে চলে যাও। তারপর সে আর কথা বলতে পারল না, কান্নায় তার গলা বন্ধ হয়ে এল।

ঝর্ণা কাঁদতে কাঁদতেই তার দুটো হাত ধরে বলল, তুমি অসুস্থ আর কথা বলল না। আমি চলে গেলে তুমি যদি শান্তি পাও, তবে নিশ্চয় চলে যাব। তবে তার আগে দু’একটা কথা বলতে চাই।। সাইফুল বলল, বল কি কথা বলবে। তুমি যে আমাকে চলে যেতে বলছ, আমি তাে যাওয়ার জন্য আসি নি। সাইফুল আশুভরা চোখে বলল, তা হলে কিসের জন্য এসেছ? তুমি আমার চিঠি পেয়ে ফিরে এসেছ তা আমি সিওর। তবু যখন চলে যেতে বলছ তখন যাব।

কিন্তু জেনে রাখ, আমার যাওয়ার মতাে কোনাে জায়গা নেই একমাত্র আত্মহত্যা ছাড়া। আমিনের কাছ থেকে চলে আসার পর অনেকবার সেই পথে যেতে চেয়েছি। কিন্তু আল্লাহর কঠিন হুঁশিয়ারীর কথা মনে করে সে পথে যেতে পারি নি। তােমার দুয়ার খােলা আছে জেনে এসেছি। তুমিও যদি সেই দুয়ার বন্ধ করে দাও, তা হলে আল্লাহর হুশিয়ারী আগ্রাহ্য করে সেই পথ বেছে নেব। তার আগে একটা অনুরােধ করব রাখবে? সাইফুলকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বলল, আমি না হয় তােমার

কাছে অপবিত্র হয়ে গেছি। কিন্তু যে ঝর্ণা তােমার হৃদয়ের রক্তের সঙ্গে অহরহ প্রবাহিত হচ্ছে, সেই ঝর্ণার মাত্র একটা অনুরােধ রাখবে না? সাইফুল আর সামলাতে পারল না। তাকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি যদি সত্যি আর ফিরে যাওয়ার জন্য এসে না থাক, তবে অনুরােধ করবে কেন? আদেশ করে। দেখ, আমি তােমার আদেশ মানি কি না?

ঝর্ণা নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বলল, এবার তুমি মদ ছেড়ে দিয়ে একটা ভালাে মেয়ে দেখে বিয়ে কর। তা হলে তুমি তােমার সেই ঝর্ণাকে ভুলে যেতে পারবে। আর। আমি দূর থেকে তােমাদেরকে দেখে শান্তিতে মরতে পারব।

সাইফুল আবার তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ঝর্ণা আমার এই অবস্থায় তুমি এত কঠিন কথা বলে বুকে ছুরি মারতে পারলে? তার চেয়ে সত্যিকার ছুরি মেরে একেবারে শেষ করে দিলে শান্তিতে মরতে পারতাম। মরার সময় ভাবতাম আমার ঝর্ণা আমাকে তিলে তিলে যন্ত্রণা না দিয়ে মেরে মুহূর্তের মধ্যে ....।

ঝর্ণা তাকে কথাটা শেষ করতে দিল না। সাইফুলের মুখে হাত চাপা দিয়ে ডুকরে কেদে উঠে বলল, প্লীজ, চুপ কর। ওয়াদা করছি, আমি আর ওরকম কথা বলব না। ঝর্ণা ভুলে গেল, বিয়ের আগে এরকম আলিঙ্গনবদ্ধ হওয়া ইসলামে হারাম। সেও তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে সাইফুলের বুকে মাথা রেখে আবার বলল, ঐ কথা বলা আমার অন্যায় হয়েছে। মাফ করে দাও বলে ফুলে ফুলে কঁদতে লাগল।

নাজনীন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছিল, আম্মাকে মামার জন্যে একগ্লাস দুধ নিয়ে আসতে দেখে মামা বলে ডেকে উঠল । নাজনীনের গলা পেয়ে ঝর্ণা আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে আঁচল দিয়ে প্রথমে সাইফুলের ও পরে নিজের চোখ-মুখ মুছে ফেলল। | মনিরা দরজার কাছে এলে নাজনীন ফিস ফিস করে বলল, একটু দাঁড়াও। আন্টি মামার সঙ্গে কথা বলছে। তারপর আম্মার হাত থেকে দুধের গ্লাসটা নিয়ে বলল, তুমি। এখন যাও, পরে আন্টির সঙ্গে কথা বলাে। আমি এটা নিয়ে যাচ্ছি।

মনিরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কিছু না বলে চলে গেল। নাজনীন আরাে একটু অপেক্ষা করে বলল, মামা তােমার দুধ নিয়ে এসেছি।। সাইফুল বলল, আয়, নিয়ে আয়। নাজনীন ভিতরে এলে ঝর্ণা এগিয়ে এসে তার হাত থেকে দুধের গ্লাসটা নিয়ে। বলল, তুমি এখন যাও। নাজনীন তাদের দিকে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে গেল। ঝর্ণা দুধের গ্লাস সাইফুলের মুখের কাছে ধরে বলল, খেয়ে ফেল।

দুধ খেয়ে সাইল বলল, এখনও কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে। কবে। আমিনের সঙ্গে তােমার ছাড়াছাড়ি হল? সব বলব, এখন একটু বিশ্রাম নাও। অনেক কথা বলেছ।। এতদিন কোথায় আছ? এক বান্ধবীর বাসায়। নাজনীনকে কত দিন পড়াচ্ছ?

এবারে যতদিন তুমি বিলেতে ছিলে। তা কি করে হয়? আমি তাে যাওয়ার আগের দিন আমার বন্ধু জায়েদের অনুরােধে তার স্ত্রীর এক বান্ধবীকে নাজনীনকে পড়াবার ব্যবস্থা করে যাই। আমিই তােমার বন্ধুর স্ত্রীর সেই বান্ধবী। আমিনের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে যেদিন তাদের বাসা থেকে চলে আসি, সেদিন থেকে ওদের বাসায় আছি। আমিন তা হলে তােমার ওপর খুব অত্যাচার করত?

ঝর্ণা ঝলছল নয়নে বলল, সে সব কথা আমাকে জিজ্ঞেস করাে না। আমি বলতে পারব। না। শুদু এতটুকু জেনে রাখ, সে পশুর চেয়ে অধম, নরকের কটী । তারপর চোখ মুছে বলল, আর কোনাে কথা নয়, চুপ করে বিশ্রাম নাও। আমি তােমার বন্ধুর বাসায় ফোন করে দিই। নচেৎ শিরীন দেরি দেখে চিন্তা করবে। তারপর ফোন করে শিরীনকে বলল, নাজনীনের মামা আজ এসেছে। আমি তার কাছে আছি। না ফিরলে চিন্তা করিস না।

তাের ডাক্তার ভাই জিজ্ঞেস করলে কি বলব? যা সত্য তাই বলবি।। তােদের মধ্যে সমঝতা হয়ে গেছে তা হলে? আল্লাহপাকের রহমতে ও তােদর দোয়ার বরকতে হয়েছে। শিরীন আলহামদুল্লাহ বলে বলল, এবার ছাড়ি তা হলে? ঝর্ণা হা ছাড় বলে লাইন কেটে দিল।।

সাইফুল জিজ্ঞেস করল, শিরীন কে? তােমার বন্ধুর স্ত্রী আর আমার বান্ধবী। এবার চুপ করে শুয়ে থাক তাে বলে ঝর্ণা তাকে শুইয়ে দিয়ে মাথার কাছে বসে তার চুলে হাত বুলােতে লাগল। আসরের আযান। শুনে বলল, আমি বুবুর রুমে গিয়ে নামায পড়ে আসি। তুমি কি নামায পড়বে?

মদ ধরার পর থেকে নামায ছেড়ে দিয়েছি।।

ঝর্ণা তার মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করল, আমার জন্যই আল্লাহর হুকুম অমান্য করে চলেছে। তার চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, আমি নামায পড়ে আসি তা হলে? এস। ঝর্ণা নামায পড়ে এসে সাইফুলের মাথার কাছে বসল। তােমার কথা শুনতে খুব ইচ্ছে করছে।

ঝর্ণা ছলছল নয়নে বলল, এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? কত দূর থেকে এসেছ, তােমার। বিশ্রাম দরকার। মনের বিশ্রাম না হলে, দেহের বিশ্রাম হবে কি করে? তােমার সব কিছু জানার জন্যে মনে অশান্তির ঝড় বইছে। তুমি বল, আমার কোনাে অসুবিধে হবে না। |

সেই নরপিশাচের কথা জিজ্ঞেস করতে একটু আগে নিষেধ করলাম। তবু যখন সেই সব কথা শােনার জন্য তুমি অশান্তি ভােগ করছ তখন বলছি শােন, তারপর ঝর্ণা। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সব কথা বলে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল।

সাইফুল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কাঁদছ কেন?
ভাগ্যে যা লেখা থাকে তা ঘটবেই। তাকে রােধ করার ক্ষমতা কারুর নেই। অতীতের কথা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর । তাই করেই তাে বেঁচে আছি। আমি নিজের কথা ভেবে কাদছি না, আমার জন্য। তােমার এই পরিণতি দেখে কাদছি।

তােমাকে আর পাব না জেনে এতদিন মৃত্যু কামনা করেছি। এখন তােমাকে দেখে বাচার জন্য আমার মন ব্যকুল হয়ে উঠছে। আমাকে বাচাবার জন্য তুমি কি এগিয়ে আসবে না? আমি তােমাকে বিয়ে করতে চাই।

ঝর্ণা, সাইফুল বলে আবার তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি আমার প্রাণের বিনিময়েও তােমাকে বাঁচাব। সেইজন্যে তাে এলাম, এই অপবিত্র দেহ নিকা তােমাকে কথাটা বলতে এতক্ষণ বিবেকে বাধছিল, তাই বলি নি। আল্লাহ আমার মনের কথা তােমার মুখ দিয়ে বার করালেন।

সাইফুল তাকে মুক্ত করে ভিজে গলায় বলল, সারা জীবনের মধ্যে আজ সর্বতos তােমাকে এত কাছে পেয়ে আনন্দের উচ্ছাসে বিয়ের কথা বলে ফেলেছি। আমি মত দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে আছি। বিয়ে করে আবার তােমাকে দুঃখের সাগরে ভাসতে দেব না মৃত্যুর সময় তােমার সেই দুঃখ আমি সহ্য করতে পারব না।

তুমি চলে যাও প্রিয়তমা। আমি তােমাকে না পেলেও এবার শান্তিতে মরতে পারব। আল্লাহর কাছে সব সময় জানাতাম, মৃত্যুর আগে একবারের জন্য হলেও যেন আমার চিরকাঙিক্ষত ঝর্ণাকে দেখতে পাই। তাই বােধ হয় তিনি তােমাকে এই শেষ সময়ে হাজির করেছেন। এমন সময় তার লিভারের। যন্ত্রণা প্রচণ্ডভাবে আরম্ভ হল। সাইফুল যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে জ্ঞান হারাল ।।

ঝর্ণা সাইফুলকে ছটফট করতে দেখে জড়িয়ে ধরেছিল। তাকে নিথর হয়ে যেতে দেখে ভয় পেয়ে ছেড়ে দিয়ে কয়েকবার নাড়া দিয়ে ডেকে সাড়া না পেয়ে আরাে বেশি ভয়। পেয়ে মনিরাকে ডাকার জন্য ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বারান্দায় নাজনীনকে দেখতে। পেয়ে বলল, তাড়াতাড়ি তােমার আমবমাকে ডাক, তােমার মামা অজ্ঞান হয়ে গেছে। নাজনীন বলল, আপনি মামার কাছে যান, আমি আম্মাকে নিয়ে আসছি।

মনিরা শুনে হাতের কাজ ফেলে একজন চাকরকে ডাক্তার আনতে পাঠিয়ে মেয়ের। সঙ্গে সাইফুলের রুমে এল। মনিরাকে দেখে ঝর্ণা বলল, আপা, শিঘ্রী কিছু ব্যবস্থা করুন। কথা বলতে বলতে হঠাৎ ছটফট করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। মনিরা বলল, ডাক্তার আনতে পাঠিয়েছি। তারপর সাইফুলের মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করল।

ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বলল, এক্ষুনি হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করুন। একটা ইনজেকসন দিয়ে ডাক্তার চলে গেল। হাসপাতালে নেয়ার আগে সাইফুলের জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফেরার পর ছটফট করতে করতে বলল, টেবিলের ওপর ওষুধের প্যাকেট থেকে দুটো ট্যাবলেট দাও। মনিরা তাকে ট্যাবলেট খাইয়ে বলল, ডাক্তার এনেছিলাম। বলে গেল তােমাকে হাসপাতালে নিতে।।

সাইফুল বলল, হাসপাতালে গিয়ে কি হবে? এখানকার ডাক্তাররা বই নকল করে পাশ করে। তারা আবার কি ডাক্তারী করবে? লন্ডনের হাসপাতালে কতদিন ছিলাম, তারাই কিছু। করতে পারল না। আমি হাসপাতালে যাব না। ঝর্ণার সঙ্গে কথা বলতে বলতে টাইম মতাে।

ওষধ খেতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই এরকম হল। এখন যন্ত্রণা কমেছে। | মনিরা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তবু তুই মদ ছাড়বি না। এবার দেখব কেমন করে মদ খাস? নাজনীনকে থাকতে বলে ঝর্ণার একটা হাত ধরে মনিরা বলল, তুমি আমার সঙ্গে এস।

আম্মা ও আন্টি চলে যাওয়ার পর নাজনীন মামার মাথার কাছে বসে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, আম্মা আন্টির পরিচয় জেনে গেছে। তুই জানিস নি? হা জানি।। কবে জানতে পারলি?

তােমার অসুখের চিঠি পাওয়ার পর। জান মামা, আন্টি খুব ধার্মিক। আমাদেরকে কত কুরআন-হাদিসের কথা বলেন। আমাকে কুরআন ও নামায পড়া শিখিয়েছেন। দেখাে, আন্টি তােমাকে আর মদ খেতে দেবেন না, আমিও দেব না। আর আম্মাও তাে। একটু আগে সে কথা বলেই গেল। তােরা ঘুমিয়ে পড়লে খাব।

ঘরে থাকলে তাে খাবে। তুমি যখন ঘুমিয়েছিলে তখন আম্মা তােমার ল্যাগেজ থেকে। সব বের করে চাকরকে দিয়ে রাস্তায় ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে। তা ছাড়া এখন আর খাবেই বা কেন? আন্টি যখন তােমার কাছে রয়েছেন। আন্টিকে ভুলে থাকার জন্যে তাে খেতে? তাের আন্টি কি চিরকাল আমার কাছে থাকবে? কেন থাকবে না? থাকার জন্য তাে এসেছেন। তুই কি করে বুঝলি?

তােমার চিঠি পাওয়ার পর আমি যেদিন তােমার অসুখের কথা আন্টিকে বললাম, সেদিন আমাকে নিয়ে ঐ বাসার তােমার রুমে গিয়েছিলেন। সবকিছু দেখে আন্টি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। আজ আবার আন্টির অবস্থা দেখে আমি বুঝতে পেরেছি আন্টির। সঙ্গে তােমার সম্পর্কে কথা। আম্মা আগেই বুঝতে পেরেছিল। তুই তাে দেখছি আমার আম্মার মতাে হয়েছিস। জানিস, শুধু ছেলে বেলায় নয়, মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত আম্মা আমার সব কিছু বুঝতে পারত।

এরা যখন মামা-ভাগ্নি কথা বলছে তখন মনিরা ঝর্ণাকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে। বলল, তােমাকে আর আপনি বলব না। আমি তােমার ও সাইফুলের সম্পর্ক বুঝতে পেরেছি। যা বলছি মন দিয়ে শােন, এখন তােমার উপর সাইফুলের জীবন মরণ নির্ভর করছে। অতীতে কি ঘটেছে,

সে সব মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা কর। আমাদের মতাে তুমিও নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ, তােমার জন্য সাইফুলের এই অবস্থা? তারপর তার দুটো হাত ধরে বলল, তুমি তােমার মন থেকে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্ধ ত্যাগ করে আমাদের বংশের ঐ একমাত্র বাতিকে বাচাবার চেষ্টা করবে না ভাই?

ঝর্ণা মনিরার চোখে পানি দেখে তাকে কদমবুসি করে উঠে জড়িয়ে ধরে চুকরে কেঁদে উঠে বলল, বুবু, আমিও যে তাই চাই। সেইজন্যেই তাে লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে ছুটে এসেছি। তুমি দোয়া কর বুবু, আল্লাহ যেন আমাকে সেই শক্তি দেন।

মনিরা তার পিঠে হাত বুলােতে বুলােতে বলল, ধৈর্য্য ধর বােন। দোয়া তাে নিশ্চয়। করব। তােমার উদ্দেশ্য সাইফুল জেনেছে? | ঝর্ণা বলল, জেনেছে। জানার পর বলল মত্য পথযাত্রী হয়ে বিয়ে করে তােমাকে আবার দুঃখের সাগরে ভাসাতে পারব না। আমিও তাকে বলেছি, তােমার কিছু হলে আমিও বাচব না। মনিরা শুনে আলহামদলিলাহ বলে তার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, এবার তুমি সাইফুলের কাছে যাও, মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে গেছে। গিয়ে নাজনীনকে পাঠিয়ে দাও ওখানে নামাযের পাটি আছে, নামায পড়ে নিও।।

সাইফুলের শত আপত্তি সত্ত্বেও মনিরা সেই রাত্রে কাজী ডেকে এনে কাবিন করে। তাদের বিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করল। ঝর্ণা ফোন করে শিরীন ও জায়েদকে সব কথা জানিয়ে তাদেরকে আসতে বলল ।

Part: 1 Part: 2 Part: 3

Post a Comment

0 Comments