অনেক সুন্দর একটি ভালবাসার গল্প
গল্পের নাম ( অসম প্রেম কাহিনী )
Part: 1
তিস্তা নদীর পাড়ে বসে সাইফুল পানির দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন।
আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে সে ঝর্ণাকে একটা চিঠি দিয়েছে। চিঠি নিয়ে ঝর্ণা যে রকম রাগের সঙ্গে তাকিয়েছিল, তাতে করে বেপরােয়া স্বভাবের সাইফুল প্রথমে একটু ভয় পেলেও পরক্ষণে বলেছিল, রাগ করাে আর যাই করাে, চিঠিটা পড়ার পর করাে। চিঠিটা কি সে না পড়ে ছিড়ে ফেলেছে, না-পড়ে ছিড়েছে? যদি পড়ে থাকে, তা হলে সে কি করবে, এই কথাই সে ভাবছে। নদীর স্রোতের কুলকুল ধ্বনি তার কানে প্রবেশ করছে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। রাখাল ছেলেরা নদীর চর থেকে গরু-ছাগল নিয়ে বাড়ি ফিরছে। নানা রকম পাখি দলবেঁধে কিচির মিচির করতে করতে নিজেদের বাসায় ফিরে যাচ্ছে। সাইফুল প্রতিদিন সন্ধ্যে পর্যন্ত নদীর পাড়ের এই জায়গায় বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে আনন্দ উপভােগ করে। আজ কোনাে দিকে তার খেয়াল নেই গ্রামের মসজিদ থেকে মাগরিবের আযান শুনে ত্রস্তাপদে নামায পড়ার জন্য মসজিদের দিকে যেতে যেতে ভাবল, ঝর্ণাকে চিঠিটা দেয়া বােধ হয় ঠিক হয় নি।
উত্তর বাংলার কুড়িগ্রাম জেলার তিস্তা নদীর পূর্ব দিকে অনন্তপুর গ্রাম। রাক্ষসী তিস্তা এই গ্রামের অনেক লােককে পথে বসিয়েছে। তবু যেন তার ক্ষুধা মিটছে না ।
ঘরবাড়ি গ্রাস করেই চলেছে। গ্রামের মাঝখানে সেমীপাকা হাইস্কুল। তার পাশে। সরকারি ফ্রি প্রাইমারি স্কুল। সাইফুলের পূর্ব পুরুষদের বাড়ি ছিল এই গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে। তিস্তা তখন তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যেত। হঠাৎ একদিন তিস্তা ক্ষেপে গিয়ে ঘরবাড়ি গ্রাস করতে লাগল ।
তখন সইফুলের দাদাজীর আমল । ওর দাদাজীর নাম কলিম উদ্দিন। কলিম উদ্দিনের বাস্তুভিটা, জমি-জায়গা, পুকুর-ডােবা ও আগান- বাগান নেহাত কম ছিল না। তিস্তা সবকিছু কেড়ে নিয়ে তাকে পথের ভিখারি করে দিল। শেষে কলিম উদ্দিন একই গ্রামের শ্বশুরের একটা পড়াে জমিতে দু'খানা বেড়ার ঘর উঠিয়ে বাস করতে লাগলেন। বার মাস যার বাড়িতে কামলারা কাজ করত, সে এখন অন্যের বাড়িতে কামলাগিরী করে সংসার চালায়। তার একমাত্র ছেলে ওসমান।
সেও বাপের সঙ্গে অন্যের ক্ষেত-খামারে কামলাগিরী করছে। যে বছর এক রকম নিঃস্ব হয়ে কলিম উদ্দিন এই গ্রামে চলে আসেন, সে বছর ওসমান এস. এস. সি’তে ভালাে রেজাল্ট করেও আর পড়াশােনা করতে পারে নি। কলিম উদ্দিন নিজের ভাগ্যের দুরাবস্থার কথা চিন্তা করে দিনের পর দিন ভেঙ্গে পড়তে লাগলেন। কলিম উদ্দিন ধার্মিক লােক। তিনি ছেলেকে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে মানুষ করেছেন।
ওসমানের কলেজে পড়ার খুব ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তার আব্বার শরীরের দিকে তাকিয়ে এবং আর্থিক দুরাবস্থার কারণে সংসারে হাল ধরতে বাধ্য হয়েছে। তার মামাদের অবস্থাও তেমন ভালাে নয়। কোনাে দিকে আশার আলাে দেখতে না পেয়ে ওসমান গ্রামের লােকজনের ক্ষেত-খামারে কাজ করে সংসার চালাতে লাগল। একবার। রংপুরে অথবা ঢাকায় এসে চাকরির চেষ্টা করবে বলে তার আম্মাকে বলেছিল ।
জেবুন্নেসা তখন বলেছিলেন, তুই আমাদের একমাত্র ছেলে। তাের আব্বা আর খাটাখাটনি করতে পারে না। তুই শহরে গিয়ে চাকরি করে কবে টাকা পাঠাবি তার কোনাে ঠিক আছে। ততদিন আমাদের চলবে কি করে? এই কথা শােনার পর সে শহরে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে দেশেই কামকাজ করতে লাগল । আর রাতে কয়েক ছেলেকে প্রাইভেট পড়িয়ে যা আয় করত, তা থেকে কিছু জমা রাখত। এভাবে কয়েক বছর কঠোর পরিশ্রম করে সংসারে কিছুটা স্বচ্ছলতা এনেছিল।
এক সময় আব্বা-আম্মার জেদাজেদিতে মামাতাে বােন মালেকাকে বিয়ে করে। বিয়ের তিন বছর পর মালেকা একটা কন্যা সন্তান প্রসব করে। কলিম উদ্দিন নাতনির নাম রাখলেন মনিরা বেগম । মনিরা জন্মাবার এক বছর পর দেড় মাসের ব্যবধানে কলিম উদ্দিন ও জেবুন্নেসা মারা যান। ওনাদের মৃত্যুর পাঁচ বছর পর সাইফুলের জন্ম হয়। ওসমান সাইফুলকে প্রথমে ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় আরবি পড়তে দেয়। আর একটু বড় হতে স্কুলে ভর্তি করে। সাইফুল ছােট বেলা থেকে খুব মেধাবী
পড়াশােনায়ও খুব মনােযােগী। কিন্তু ভীষণ চঞ্চল ও বেপরােয়া। পাড়ার ছেলেদের সাথে নিজেও যেমন মারামারি, ঝগড়া-ঝাটি করে, তেমনি অন্যদের দ্বারা ঐ সব করাতেও ওস্তাদ।
সাইফুল যখন কিশাের বয়সে পড়ল তখন ওসমান ছেলেকে কড়া শাসনে ধর্মীয় শিক্ষা। দিয়ে সেই মতাে চালাত। হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে তার স্বভাবের সবকিছু পরিবর্তন হল।
কিন্তু বেপরোয়া ভাবটা রয়ে গেল। সমাজের কেউ কিছু অন্যায় করলে, তার বিচার না হওয়া পর্যন্ত তাকে ছেড়ে কথা কয় না। শিশুকাল থেকে সাইফুল একটু রােগা। এখন সে তরুণ। মাঝারি ধরনের লম্বা একহারা শরীর। গায়ের রং ঠিক ফর্সা নয়, ঈষৎ চাপা।
উন্নত নাক, মুখের দিকে তাকালে বেপরােয়া ভাবটা বেশ বােঝা যায়। নিচের ক্লাস থেকে সে ফাট হয়ে আসছে। সেই জন্যে তার বেপরোয়া স্বভাব জেনেও স্কুলের ছাত্র- ছাত্রীরা এমন কি শিক্ষকরাও তাকে মনে মনে ভালবাসে। এই গ্রামে মেয়েদের জন্য কোনাে আলাদা স্কুল না থাকায়, ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে ক্লাস করে। প্রত্যেক ক্লাসে ছেলেরা একদিকে বসে, আর মেয়েরা অন্য দিকে । মধ্যখান দিয়ে যাতায়াতের রাস্তা।
সরকারি ফ্রি প্রাইমারী স্কুল থেকে সাইফুল বৃত্তি নিয়ে পাশ করে হাই স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়। প্রথম যেদিন সাইফুল স্কুলে আসে, সেদিন ঝর্ণার দিকে সে বারবার তাকিয়ে দেখেছে । ক্লাসের সব মেয়েদের চেয়ে বর্ণাকে বেশি সুন্দরী মনে হয়েছিল।
হাটবেলা থেকে সে যেকোনাে সুন্দর জিনিসকে ভালবাসে। প্রাকৃতিক দৃশ্য তাকে সব থেকে বেশি আকর্ষণ করে। তাই সে খেলাধূলার চেয়ে নদীর পাড়ে ঘুরে ঘুরে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে। ঝর্ণাকে দেখার পর থেকে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য সাইফুলের মন
ছটফট করত। কয়েকদিন পর একদিন টিফিনের সময় ঝর্ণার কাছে গিয়ে তার নাম জিজ্ঞেস করেছিল। ঝর্ণা তার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে চুপ করেছিল।
তখন তার সাথের মেয়েটা ঝর্ণার নাম বলে। আরাে অনেক পরে সাইফুল তার আব্বর নাম জেনেছিল হামিদ চেয়ারম্যান। ঝর্ণা হাই স্কুলের মর্নিং সিফটে বেতন দিয়ে ক্লাস
ওয়ান থেকে পড়ে আসছে। আর সাইফুল গরিবের ছেলে বলে সরকারি ফি প্রাইমারী স্কুলে পড়েছে। তাই সে ঝর্ণাকে চিনত না।
ঝর্ণাও নিচের ক্লাস থেকে ফাষ্ট হয়ে এসেছে। সে বছর সিক্স থেকে সেভেনে ওঠার সময় সাইফুল ফাস্ট আর ঝর্ণা সেকেণ্ড হয়। রেজাল্টের দিন সেকেণ্ড হয়েছে জেনে ঝর্ণা কেঁদেছিল। সেই সঙ্গে সাইফুলের প্রতি তার খুব রাগ হয়েছিল, আর মনে মনে ভেবেছিল, সামনের বছর সাইফুল কেমন করে ফাস্ট হয় দেখবে। কিন্তু সে বাসনা আজ পর্যন্ত পূরণ হয়নি। ফলে সাইফুলের প্রতি রাগ ও ঘৃণা বছরের পর বছর বাড়তেই থাকে। কোনাে কোনাে সময় সাইফুল তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে, ঝর্ণা মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। এখন তারা ক্লাস টেনে পড়ে।
bangla love story book
গত সপ্তাহে যেদিন টেস্টের রেজাল্ট বেরােল, সেদিন ঝর্ণা প্রথম সাইফুলের সঙ্গে কথা বলে। ঐ দিন রেজাল্ট জানার জন্য সাইফুল স্কুলে গিয়ে দেখল, ঝর্ণা নােটিশ বাের্ডের কাছে কয়েকজন মেয়ের সাথে কথা বলছে।
সাইফুলকে দেখে ঝর্ণা বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, তুমি আবার এসেছ কেন ? ভালাে ছাত্রদের রেজাল্ট তাে জানাই থাকে।
ঝর্ণার বিদ্রুপের হাসি সাইফুল বুঝতে পেরেও গায়ে মাখল না। যেচে কথা বলেছে। এটাই তার কাছে সৌভাগ্য বলে মনে হল। সেও হাসিমুখে বলল, ভালাে ছাত্ররাও অনেক সময় ফেল করে। তা ছাড়া তুমিও তাে ঐ দলের ; তবে তুমি কেন এসেছ? সাইফুলকে হেসে কথা বলতে দেখে ঝর্ণা মুখ ঘুরিয়ে সঙ্গিদের নিয়ে চলে গেল।
ঝর্ণার সঙ্গে কথা বলার পর সাইফুলের বেপরােয়া ভাবটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।
তাই ভালাে-মন্দ না ভেবে সে আজ তাকে চিঠি দেয়। স্কুলের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা উত্তর-দক্ষিণে গেছে। ঝর্ণাদের ঘর উত্তর দিকের গ্রামের রাস্তার শেষ প্রান্তে। আর সাইফুলদের ঘর দক্ষিণ দিকের গ্রামের শেষ প্রান্তে। স্কুলে আসার আগে সাইফুল চিঠিটা লিখে এনেছিল। ভেবেছিল, কোনাে এক ফাকে ঝর্ণাকে দেবে। কিন্তু সে সুযােগ পেল । তাই ছুটির সময় সাইফুল আগে ক্লাস থেকে বেরিয়ে ঝর্ণাদের বাড়ির রাস্তায় কিছু দূরে এসে একটা বড় আমগাছের আড়ালে দাঁড়াল। সৌভাগ্যক্রমে রাস্তায় তখন কোনাে লােকজন ছিল না। একটু পরে ঝর্ণাকে তাদেরই ক্লাসের বেলী নামে একটা মেয়ের সঙ্গে আসতে দেখল। কাছে এলে সাইফুল আমগাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চিঠিটা তার হাতে একদম গুঁজে দিল।
ঝর্ণা ভাবতেই পারেনি, সাইফুল তাকে চিঠি দেবে। প্রথমে ভ্যাবাচ্যাখা খেয়ে গিয়েছিল। পরক্ষণে যখন রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল, এটাতে কি লিখেছ? তখন সাইফুল ঐ কথা বলে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় ।
মাগরিবের নামায পড়ে ঘরে এসে সাইফুল পড়তে বসে কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারল না। কেবল ঝর্ণার কথা মনে পড়তে লাগল।
পরের দিন স্কুলে এসে কয়েকবার আড়চোখে ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে তার মনের ভাব কিছু বুঝতে পারল না।
প্রথম ক্লাস হেডমাস্টার তাহের সাহেবের। তিনি ক্লাস টেনের এই সেকশনে অংক করান। আজ ক্লাসে এসে রােল কল শেষ করে সাইফুলের কাছে অংকের বই চাইলেন। সাইফুল বইটা দেয়ার আগে ঝর্ণা এসে একটা চিঠি স্যারের টেবিলের উপর রেখে আস্তে আস্তে বলল, গতকাল সাইফুল আমাকে দিয়েছে। তারপর ফিরে এসে নিজের সিটে বসে পড়ল।
তাহের সাহেব সেটা পড়ে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে একবার ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে সাইফুলের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ঝর্ণাকে হেডস্যারের কাছে চিঠিটা দিতে দেখে সাইফুলের হৃৎকম্পন শুরু হল। তারপর স্যারকে ঐ ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভয়ে তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। সে অংকের বইটা দেয়ার জন্য বইটা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই অবস্থায় সে মাথা নিচু করে রইল।
স্কুলের সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকা জানে, হেডস্যার তাহের সাহেব যেমন খুব ভালাে শিক্ষক তেমনি অত্যন্ত আদর্শবান। কোনাে অন্যায়কে তিনি প্রশ্রয় দেন না, তা সে যেই হােক না কেন? ঝর্ণা যখন চিঠিটা স্যারকে দেয় তখন ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে সেদিকে চেয়েছিল। সবাই জানে হেডস্যার হঠাৎ রাগেন না।
কিন্তু কোনাে কারণে রেগে গেলে তখন আর ওনাকে চেনা যায় না। ফর্সা গােলগাল মুখটা রাগে লাল হয়ে যায়। ঝর্ণার চিঠি পড়ে স্যারকে সাইফুলের দিকে ঐভাবে তকিয়ে থাকতে দেখে তারা ভয়ে আতংকিত হয়ে পড়ল। সবাই ফিস ফিস করে বলাবলি করতে লাগল, আজ সাইফুলের নিস্তার নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের গুঞ্জন শুনে তাহের সাহেব টেবিলে ডাষ্টার ঠুকে গর্জে উঠলেন, চুপ কর।
স্যারের কথা শুনে ছেলেমেয়েরা সব চুপ হয়ে গেল । তাহের সাহেবের হাতে সব সময় একটা বেতের চাবুক থাকে। স্কুলে যতক্ষণ যেখানেই থাকেন, বেতটা সঙ্গে থাকবেই। অবশ্য কেউ গুরুতর অন্যায় না করলে কাউকে কখনাে বেত্রাঘাত করেন না। ছােটখাট অন্যায় কেউ করলে বেত নাচিয়ে ভয় দেখিয়ে বুঝিয়ে তাকে সাবধান করে দেন। তিনি চিন্তা করতেই পারছেন না, সাইফুলের মতাে ছেলে এই কাজ করবে। গম্ভীরস্বরে ডাকলেন, সাইফুল, এদিকে এস।
হেডস্যারের এই স্বর সকলের জানা। তারা ভাবল, আজ সাইফুলের রক্ষা নেই। যারা সাইফুলকে দেখতে পারত না, তারা মনে মনে খুব খুশী হল। আর অন্যরা ভয়ে আল্লাহ।
আল্লাহ করতে লাগল । সাইফুলও বুঝতে পেরেছে এখন কি ঘটবে। তাই সে স্যারের ডাক শুনে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। চিঠিতে সাইফুলের নাম নেই। তাহের সাহেব সাইফুলের হাতের লেখা চেনেন।
এবং ঝর্ণাও তার নাম বলেছে। তবু সত্য মিথ্যা যাচাই করার জন্য জিজ্ঞেস করলেন, এটা তােমার লেখা? সাইফুল ভয়ে ও লজ্জায় কিছু বলতে পারল না। মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
তাহের সাহেব একই স্বরে বললেন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? উত্তর দাও। সাইফুল ঢােক গিলে কোনাে রকমে বলল, জি। তাহের সাহেব দাঁড়িয়ে সারা শরীরে বেতের পর বেত মেরে চললেন। সাইফুল ঠোটে ঠোট কামড়ে নিজেকে সামলানর আপ্রাণ চেষ্টা করল। মুখ দিয়ে কোনাে শব্দ বের হল না। শুধু চোখ দিয়ে অবিরল পানি পড়ছে। এক সময় তার মনে হল সে বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাবে।
মারতে মারতে তাহের সাহেব ক্লান্ত হয়ে মারা বন্ধ করে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, যাও, বস গিয়ে। আর কখনাে এরকম ঘটনা যেন না শুনি। সাইফুল কোনােরকমে টলতে টলতে নিজের সিটে এসে বসে পড়ল।
তাহের সাহেব ছেলেদের জিজ্ঞেস করে দু'তিনটে হােম টাক্সের কঠিন অংক বাের্ডে করে বুঝিয়ে দিলেন। তারপর ঘন্টা পড়তে হােমটাক্স দিয়ে তিনি ছাত্র হাজিরা খাতা, ডাষ্টার, চক, বেত ও চিঠিটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
হেডস্যার চলে যাওয়ার পর ক্লাসের মধ্যে আবার গুঞ্জন উঠল। ছেলেরা মেয়েদের দিকে বাঁকা চোখে তাকাতে তাকাতে রাগে ফুলতে লাগল। মেয়েদের মধ্যে যারা চিঠির কথা জেনেছিল, তারা বলল, ঠিক হয়েছে। আর অন্যরা ঝর্ণার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, সাইফুল তােকে কি এমন লিখেছিল, যার জন্য হেডস্যারকে দিয়ে মার খাওয়ালী? ঝর্ণা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, যা লিখেছে তা যদি তােদেরকে লিখতাে, তা হলে তােরাও আমার মতাে করতি।
গতকাল ঝর্ণা স্কুল থেকে ঘরে ফেরার সময় যখন তেমাথা রাস্তায় এল তখন সাইফুল এই চিঠিটা তাকে দেয়। ঝর্ণার একবার মনে হয়েছিল, চিঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দেবে। কিন্তু সাইফুলের কথা শুনে কি লিখেছে জানার আগ্রহে তা না করে শুধু একবার তার দিকে অগ্নি দৃষ্টি হেনে চলে আসে। নিজের রুমে এসে চিঠিটা খুলে দেখতে পেল, পুরাে চিঠিটাতে শুধু “ঝর্ণা আই লাভ ইউ" লেখা । পড়ে তার মাথা গরম হয়ে গেল।
চাচাতাে বােন বেলী রাস্তায় ঝর্ণাকে বলেছিল, কিরে চিঠিতে সাইফুল কি লিখেছে পড়বি ? ঝর্ণা তখন বলেছে, ঘরে গিয়ে পড়ব। তুইও আমার সঙ্গে চল । এখন তার হাতে চিঠিটা দিয়ে বলল, পড়ে দেখ, ফকিরের ছেলের সাহস কত? যার গায়ে তালি দেয়া ময়লা জামাকাপড় দেখলে বােঝা যায় তার বাপের অবস্থা। সে কি না আমাকে ভালবাসে। তারপর বলল, কি করা যায় বলতাে? চিঠিটা আব্বাকে দিয়ে ছেলেটাকে শায়েস্তা করতে বলবাে? বেলী বলল, তার চেয়ে হেডস্যারকে দিলে আরাে ভালাে হবে। গরিবের ঘােড়া রােগে ধরেছে। তুই হেডস্যারকেই দে। বাছাধনকে একদম প্রেমের ঘােল খাইয়ে। ছাড়বেন।
ঝর্ণা স্কুলে আসার পর থেকে চিন্তা করেছে, কখন চিঠিটা স্যারকে দেয়া যায় । রােল কলের পর দেবে ভেবে রেখেছিল। তাই স্যার যখন সাইফুলের কাছে অংকের বই। চাইলেন তখন সে তার আগে চিঠিটা দিয়েছে। হেডস্যার যখন সাইফুলকে মারতে ছিলেন তখন ঝর্ণা তার করুন অবস্থা দেখে মনে মনে হেসেছে আর বলেছে, এখন বুঝে বড় লােকের মেয়েকে ভালবাসার ফল।
ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারল, সাইফুল নিশ্চয় ঝর্ণাকে প্রেম পত্র দিয়েছিল। তবু কয়েকজন ছেলে তাকে জিজ্ঞেস করল, ঝর্ণাকে চিঠিতে কি লিখেছিলি? সাইফুল তাদের কথায় কান না দিয়ে বই খাতা নিয়ে বাড়ি চলে গেল? সাইফুলের আব্বা ওসমান ক্ষেতের কাজ সেরে স্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে ঘরে ফিরছিল। মােরসেদ তাকে দেখতে পেয়ে কাছে গিয়ে বলল, ওসমান চাচা, সাইফুল ঝর্ণাকে চিঠি দিয়েছিল বলে হেডস্যার তাকে ভীষণ মেরেছেন।
ওসমান জিজ্ঞেস করল, সাইফুল কোথায় ? মােরসেদ বলল, মার খাওয়ার পর সে ঘরে চলে গেছে। ওসমান তাকে আর কিছু না বলে ঘরের দিকে চলে গেল । মােরসেদ সাইফুলের বন্ধু। একই পাড়ায় ঘর ।
মােরসেদ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে।
সাইফুলকে হেডস্যার যখন মারতেছিলেন তখন তারও খুব কষ্ট হয়েছে। ঝর্ণাকে যে সাইফুল ভালবাসে, তা মােরসেদ জানত। কিন্তু চিঠি দেয়ার কথাটা জানত না। সাইফুল তাকে না জানিয়ে ঝর্ণাকে চিঠি দিয়েছে জেনে তার উপর মােরসেদের একটু মনে কষ্ট হল। বিকেলে তাদের ঘরে গিয়ে জ্বর শুনে তার কাছে গিয়ে কথাটা না বলে পারল না। তারপর আরাে বলল, তুই যদি আগে আমাকে চিঠির কথা জানাতিস, তা হলে এরকম হত না।
সাইফুল স্লান হেসে বলল, তুই মনে কষ্ট নিস না। চিঠি দেয়ার কথা আমার আগে মনে হয় নি। আজ স্কুল যাওয়ার আগে হঠাৎ খেয়াল টাঘাড়ে চাপে। তাই তখনই লিখি । স্কুলেও তােকে জানাবার সুযােগ পাইনি।
ওসমান মােরসেদের কাছে ছেলের অপকর্মের কথা শুনে খুব রেগে যায়। ঘর এসে ছেলের ওপর ভীষণ রাগারাগি করল। ঐদিন রাত থেকে সাইফুল কয়েকদিন জ্বরে ভুগল। খবর পেয়ে হেডস্যার তাহের সাহেব সাইফুলকে একদিন এসে দেখে গেছেন।
ঐদনি রেগে দিয়ে তিনি সাইফুলকে কঠিন শাস্তি দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু পরে সে কথা চিন্তা করে ওঁর চোখ দুটো পানিতে ভরে গেছে। ভাবলেন, তাকে বেশি ৱেহ করি বলে কি শাসনটাও বেশি করে ফেললাম? তাকে স্কুলে আসতে না দেখে মােরসেদকে জিজ্ঞেস করেন, সাইফুল স্কুলে আসছে না কেন তুমি জান?
মােরসেদ বলল, তার জ্বর হয়েছে। সেইদিনই তিনি সাইফুলকে দেখতে যান ।
সাইফুলের বড় বােন মনিরা যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন ওসমান ভালাে সম্বন্ধ পেয়ে তার বিয়ে দিয়ে দেন সাইফুলের ঘটনাটা সে জানতে পারল না। সাইফুল ভালাে। হয়ে বলল, আমি আর ঐ স্কুলে পড়ব না
শুনে ওসমান রেগে গিয়ে বলল, অন্যায় করেছিলি, সে জন্যে মাস্টার শাসন। করেছেন। তাতে স্কুল কি দোষ করল?
সাইফুল বলল, আমি কিছুতেই ঐ স্কুলে আর পড়বাে না।
ওসমান চিন্তা করল, মনিরা পরের ঘরে, সাইফুলকে কড়াকড়ি করলে সে যদি কোথাও চলে যায়? তাই বেশি বকাবকি না করে বুঝিয়ে বলল, কয়েক মাস পরে তাের ফাইন্যাল পরীক্ষা। সে জন্যে স্কুলের বেতন, কোচিং চার্জ ও পরীক্ষার ফি সবকিছু দেয়া হয়ে গেছে। তা ছাড়া এখন তাে তুই অন্য স্কুল থেকেও পরীক্ষা দিতে পারবি না। ওসব পাগলামি ছাড়, এই কটা মাস মন দিয়ে পড়াশােনা করে পরীক্ষাটা দিয়ে দে। তারপর তুই তাে কলেজে পড়বি।
সাইফুল স্পষ্ট জানিয়ে দিল, আমি এবছর পরীক্ষা দেব না, পরের বছর দেব। ওসমান ছেলের কথা শুনে খুব রেগে গেলেও কিছু বলল না। চুপি চুপি হেডস্যারের কাছে গিয়ে ছেলের মতামতের কথা বলে বােঝাতে বলল।
তাহের সাহেব বললেন, অত ভালাে ছেলে শিক্ষকের হাতে মার খেয়ে পরীক্ষা দেবে না, এ কেমন কথা? স্কুলে আসতে যদি তার লজ্জা হয়, তা হলে বাড়িতে পড়ে। পরীক্ষা দিক। সাইফুল যে স্কলারশীপ পাবেই সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত। স্কলারশীপ পেলে আমাদের স্কুলের ও গ্রামের কত গৌরব হবে। না-না তা হতে দিতে পারি না। চলুন, আমি আপনার সঙ্গে গিয়ে বােঝাব।
bangla love story
সাইফুল দূর থেকে আব্বার সঙ্গে হেডস্যারকে আসতে দেখে ঘরের পিছনের কলাবাগান দিয়ে পালিয়ে গেল। তারপর সে আর ঘরে ফিরল না। সেদিন বিকেলে মধুপুরে বুবুদের বাড়িতে এসে রাত কাটাল। সকালে মনিরার কাছ থেকে কয়েকটা টাকা চেয়ে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা দিল ।
এদিকে ওসমান হেডস্যারকে বসতে বলে সাইফুলকে দেখতে না পেয়ে স্ত্রীকে তার কথা জিজ্ঞেস করল। মালেকা বলল, একটু আগেও তাে ঘরে ছিল। মনে হয় তােমার সাথে হেডস্যারকে। আসতে দেখে বাইরে চলে গেছে।
ওসমান স্ত্রীকে কিছু নাস্তার ব্যবস্থা করতে বলে স্যারের কাছে এসে বলল, ওর আম্মা বলল, একটু আগে ঘরে ছিল, আমাদের আসতে দেখে পালিয়েছে। হেডস্যার বললেন, এখন তা হলে চলি; আর একদিন আসব। ওসমান বলল, একটু বসুন। গরিবের বাড়ি এসেছেন, কিছু মুখে না দিয়ে যেতে পারবেন না।
হেডস্যার নাস্তা খাওয়ার পরও সাইফুলের জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে গেলেন। সেদিন রাতেও যখন সাইফুল ফিরে এল না তখন মালেকা স্বামীকে বলল, ও বােধ হয় মনিরাদের বাড়ি গেছে। তুমি কাল সকালে গিয়ে নিয়ে এস। ওসমান তখন স্ত্রীকে কিছু না বললেও সকালে নাস্তা খেয়ে মেয়ের বাড়িতে রওয়ানা দিল।
মাইল তিনেক দূরে মধুপুর গ্রামে মনিরার বিয়ে হয়েছে। জামাইয়ের নাম কাওসার। সুন্দর স্বাস্থ্যবান ছেলে। মা-বাপ নেই। এক ফুফু তাকে মানুষ করেছে। ফুফু নিঃসন্তান বিধবা। তিন কূলে তারও কেউ নেই। সেই ফুফুর বাস্তু ভিটা, আগান-বাগান ও কিছু ক্ষেতি জমি আছে। কাওসার ফুফুকেই মা বলে জানে। তার জন্মের কয়েকদিন পর তার মা মারা যায়। ফুফু পনের দিনের ভাইপেকে নিয়ে এসে মানুষ করেছে।
নিঝঞাট সংসার দেখে ওসমান মনিরাকে সেই ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে। বিয়ের বছর দুই পরে মনিরার একটা মেয়ে হয়। ওসমান খবর পেয়ে নাতনিকে দেখতে গিয়ে তার নাম রাখে নাজনীন । নাজনীন যখন দু'বছরের তখন মনিরার ফুফুশাশুড়ী মারা যায়। কাওসার খুব কর্মঠ ছেলে। নিজের ও গ্রামের লােকের ক্ষেতে-খামারে কাজ করে। বেশ ভালাে ভাবেই সংসার চালিয়ে আসছে। ওসমান যখন মেয়ের বাড়ি গিয়ে পৌছাল তখন বেলা দশটা।
মনিরা আব্বাকে এক বদনা পানি দিয়ে বলল, অজু করে ঠান্ডা হন। ওসমান ওজু। করে বসার পর মনিরা একটা বড় গ্লাসে করে একগ্লাস পানি, এক গ্লাস সরবৎ ও পানের সরঞ্জাম নিয়ে এসে সামনে রেখে হাত পাখা দিয়ে আব্বাকে বাতাস করতে করতে খবরা-খবর জিজ্ঞেস করল ।
ওসমান সরবৎ খেয়ে একটা পান সেজে মুখে দিয়ে সাইফুল এখানে এসেছিল কিনা জিজ্ঞেস করল।
মনিরা বলল, সাইফুল কাল বিকেলে এসেছিল। আজ সকালে নাস্তা খেয়ে আমার কাছ থেকে বিশ টাকা চেয়ে নিয়ে গেল। আবার কপালে চিন্তার ছাপ দেখতে পেয়ে
জিজ্ঞেস করল, সাইফুলের কি হয়েছে? তুমি কিছু বলেছ? ওর সামনে পরীক্ষা।
পড়াশােনা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন? ওসমান একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সব কথা বলল।
শুনে মনিরার মন খারাপ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ও যা ছেলে, একবার যখন বলেছে এ বছর পরীক্ষা দেবে না তখন কি আর দেবে? আমার মনে হয় সে ঘরে না গিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। তুমি ওর জন্য চিন্তা করাে না।
আব্বা। ছােট না, খাট না, অতবড় ছেলে হয়ে যদি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারে, তাতে তােমার কি করার আছে? এবেলা থেকে খেয়েদেয়ে ওবেলা যাবে ।
এমন সময় মনিরার মেয়ে নাজনীন স্কুল থেকে এসে নানাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে বই খাতা রেখে কদমবুসি করে বলল, কেমন আছেন নানা? নানি ভালাে আছে? মামা কালকে এসেছিল, আজ সকালে নাস্তা খেয়ে চলে গেল। কত করে বললাম থাকতে, থাকল না। আপনাকে আজ থাকতে হবে কিন্তু।
ওসমান নাতনীকে দু'হাতে ধরে কোলে বসিয়ে মাথায় চুমাে খেয়ে দোয়া করে বললেন, হ্যা ভাই আমরা সবাই ভাল আছি। তুমি এখন কোন ক্লাসে পড়?
নাজনীন বলল, নানা ভাই, আপনি বডত ভুলে যান। সেবারে যখন এলেন তখন বলেছিলাম না, থ্রিতে পড়ি?
ওসমান মনিরাকে বলল, তাের মেয়ে একদিন লেখাপড়ায় খুব ভালাে হবে দেখিস।
তারপর বলল, এবার যাই মা, তাের মা আবার ওদিকে চিন্তা করবে। মনিরা বলল, চিন্তা করবে কেন? আম্মা তাে জানে তুমি এখানে এসেছ।
নাজনীন বলে উঠল, আমি আপনাকে যেতে দিলে তাে যাবেন। তারপর সে ছাতাটা নিয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রেখে এসে বলল, এবার যান তাে দেখি কেমন করে যাবেন। গেলে রােদে মাথা ফেটে যাবে।
ওসমান হেসে উঠে মনিরাকে বলল, তাের মেয়ের বুদ্ধি দেখেছিস? আমাকে যেতে দেবে না বলে আমার ছাতা লুকিয়ে রেখে রােদের ভয় দেখাচ্ছে।
মনিরা হাসিমুখে নাজনীনকে বলল, তুই স্কুলের জামা খুলে এসে নানার সাথে গল্প। কর, আমি রান্নার ব্যবস্থা করি।
সেদিন বিকেলে ওসমান ঘরে ফিরে স্ত্রীকে সাইফুলের কথা জানাল? তারপর বেশ কিছুদিন পার হয়ে যেতেও যখন সাইফুল ফিরে এল না তখন তারা আল্লাহর কাছে ছেলের সহিসালামতের জন্য এবং তাকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কান্নাকাটি করে দোয়া। চেয়ে সবুর করে রইল।
মনিরা মাঝে মাঝে এসে আব্বা-আম্মাকে প্রবােধ দিয়ে যায়। সাইফুলের ঘটনা গ্রামের লােকজন জেনে অনেক দুঃখ প্রকাশ করল। কিন্তু ঝণী তাকে মনের মতাে শাস্তি দিতে পেরেছে ভেবে ও তার পড়াশােনা বন্ধ করে গ্রাম ছাড়া করতে পেরে খুব খুশী হয়েছে।
সেদিন সাইফুল বুবুর বাড়ি থেকে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় এসে ছেলে মেয়েদের পড়াবার বদলে থাকা-খাওয়ার লজিং এর অনেক চেষ্টা করল।
অচেনা ছেলেকে দরকার থাকলেও কেউ রাখতে চাইল না। থাকা-খাওয়ার তার খুব কষ্ট হতে লাগল। শেষে কোনাে উপায় না দেখে এক রিক্সাওয়ালাকে অনেক অনুনয় বিনয় করে তার কাছে রিক্সা চালান শিখে রিক্সা চালাতে লাগল। আর রিক্সার মালিককে বলে তার গ্যারেজে রাত কাটাত। শহরে এসে এতাে কষ্টের মধ্যেও সে কিন্তু নামায ছাড়ে নি। সে ফার্মগেটের গ্যারেজের রিক্সা চালায়।
একদিন ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমার সামনে রাত এগারােটার সময় হুড তুলে বসে আছে। তখন শ্রাবণ মাস। তিন-চার দিন একটানা বৃষ্টির পর আজ সকাল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। সিনেমার প্যাসেঞ্জারদের জন্য সে অপেক্ষা করছে। এই সময়ে প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে ভালাে ভাড়া পাওয়া যায়। এমন কি নিরাপদে পৌছে দিলে দু’পাঁচ টাকা বখশীষও মিলে। সিনেমা সাড়ে এগারােটায় ভাঙ্গল। ভাগ্যক্রমে মীরপুর এক নাম্বারের দু'জন প্যাসেঞ্জার পেল। এতরাতে অতদূরে যাওয়ার ইচ্ছা সাইফুলের না। থাকলেও পঁচিশ টাকা ভাড়া দেবে শুনে রাজি হয়ে গেল।
এক নাম্বার পানির ট্যাংকীর পাশে একটা গলিতে নেমে ভাড়া দেওয়া তাে দূরের কথা, তারা দু'জনে দুটো চাকু বের করে ভয় দেখিয়ে সাইফুলের সারাদিনের রােজগার কেড়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে বলল । চালাকি করে লােকজন ডাকার চেষ্টা করলে, জানে শেষ করে দেবার হুমকিও দিল ।
তাদের দু'জনের কাছে দুটো চাকু ছিল বলে সাইফুল কিছু বলল না। মনের কষ্ট মনে চেপে ফিরে আসতে লাগল। আজ চার মাস হল সে ঢাকায় এসেছে। রিক্সা চালিয়ে সারাদিনে যা রােজগার করে, তা থেকে নিজের খরচ ও রিক্সার জমা টাকা দিয়ে যা বাঁচে তার সবটাই গ্যারেজের মালিকের কাছে জমা রাখে। তার ইচ্ছা প্রয়ােজন মতাে টাকা জমা হলে স্কুলে ভর্তি হয়ে এস.এস.সি. পরীক্ষা দিবে।
আজ তার বেশ ভালাে উপার্জন হয়েছিল। এতগুলাে টাকা খােয়া গেল ভেবে তার চোখে পানি এসে গেল। কল্যাণপুর পার হয়ে পােলটার উপর উঠেছে এমন সময় শুধু কোমরে চট জন একজন ফকিরের মতাে লােক তার পথ আগলে বলল, এই বেটা, তাের কাছে কি আছে দে। আজ তিন দিন আমার কিছু খাওয়া হয় নি।
সাইফুল রিক্সা থেকে নেমে বলল, আমার আজকের সব রােজগর একটু আগে দু’জন প্যাসেঞ্জার কেড়ে নিয়েছে। কিছু থাকলে নিশ্চয় দিতাম। আপনি আমার রিক্সায় উবুন। আমি যেখানে থাকি, সেখানে নিয়ে গিয়ে খাওয়াব। ফকিরটা হাে হাে করে হেসে উঠল।
রাত প্রায় একটার মত । এই গভীর রাতে ফকিরের হাসির শব্দে সাইফুল ভয় পেয়ে গের। সাহস করে বলল, হাসছেন কেন? গেলে চলুন। দেখছেন না, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভিজে গেছি। আমার ঠান্ডা লাগছে।
ফকিরটা সাইফুলের কাছে এসে নিজের আঙ্গুল থেকে একটা আংটি খুলে তার ডান হাতের মধ্যমায় পরিয়ে দিয়ে বলল, যা বেটা, তুই কি আমাকে খাওয়াবি। আসমানের দিকে আঙ্গুল তুলে আবার বলল, আল্লাহ সবার রেজেকদাতা। সেই সবাইকে খাওয়ায়।
তুই খুব সাবধানে থাকবি। ফরয নামায আর ফরয রােযা জীবনে কখনাে ছাড়বি না। যদি ছাড়িস তা হলে এই আংটি তাের কাছে থাকবে না। আর তুই বিপদেও পড়বি। সব সময় আল্লাহকে স্মরণ করবি। তা হলে তাের মনস্কামনা পূরণ হবে।
love story book
ফকিরের কথা শুনে সাইফুল হা করে তার দিকে চেয়ে রইল।
চেয়ে থাকতে থাকতে এক সময় তার মনে হল, ফকিরকে আর দেখতে পাচ্ছে না। দু'হাতে চোখ রগড়ে চারপাশে তাকিয়ে খুব অবাক হয়ে গেল। কোথাও ফকিরটা নেই। ভাবল, তা হলে কি সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখেছিল? আংটির কথা মনে পড়তে হাতটা তুলে দেখল, আংটিটা আঙ্গুলে রয়েছে। আল্লাহর নাম স্মরণ করে রিক্সায় উঠে গ্যারেজে ফিরে এল। সকালে মালিককে গত রাতে শুধু টাকা খােয়া যাওয়ার ঘটনাটা বলল ।
মালিক বললেন, ভালাে-মন্দ দেখে প্যাসেঞ্জার তুলতে হয়। সেই ঘটনার দিন পনের পর একদিন একটা প্যাসেঞ্জার নিয়ে মতিঝিল এল।
প্যাসেঞ্জার নামিয়ে গ্রীনলেজ ব্যাংকের সামনে দিয়ে আসার সময় একজন ভদ্রলােক রিক্সায় উঠে পুরানা পল্টনে যেতে বললেন।
ঠিকানা মতে পৌছে দিয়ে বেশ কিছু দূর ফিরে আসার পর রিক্সার পাদানিতে কিছু পড়ার শব্দ পেয়ে পিছন ফিরে দেখল, একটা মাঝারি সাইজের চামড়ার ব্যাগ রিক্সার পাদানিতে পড়ে রয়েছে। রিক্সা থেকে নেমে
সাইফুল ব্যাগটা হাতে নিয়ে বুঝতে পারল, ব্যাগটা বেশ ভারি। চেন টেনে খুলে অবাক হয়ে গেল। ব্যাগটা পাঁচশাে টাকার নােটে ভর্তি । তাড়াতাড়ি বন্ধ করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সেটা গদীর নিচে রেখে সেই ভদ্রলােকের বাসায় ফিরে চলল।
এদিকে ভদ্রলােক টাকার ব্যাগের কথা ভুলে গেছেন। অসুস্থ স্ত্রীকে রেখে তিনি অফিসে গিয়েছিলেন। দুপুরে বাসায় খেতে আসার সময় স্টাফদের বেতন দেবেন বলে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে রিক্সায় করে এসেছেন। খাওয়া-দাওয়া করে স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে বেরােবার সময় টাকার ব্যাগের কথা মনে পড়ল। টাকার ব্যাগ না।
পেয়ে হতাশ হয়ে বসে ভাবলেন, নিশ্চয় রিক্সায় রয়ে গেছে। গাড়ি থাকলে এরকম হত । ভুলে গেলেও ব্যাগটা গাড়িতেই থাকত। এরকম কয়েকবার হয়েছে। গাড়িটা ট্রাবল দিচ্ছিল বলে ওয়ার্কশপে দিয়েছেন। এমন সময় দারােয়ান এসে বলল, একটা রিক্সাওয়ালা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছে।
ভদ্রলােক একটা কোম্পানীর মালিক। নাম জালাল সাহেব। দারােয়ানর কথা শুনে জালাল সাহেব চমকে উঠে বললেন, তাকে ভিতরে নিয়ে এস।
সাইফুল ব্যাগটা গামছা দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে দারােয়ানের সঙ্গে ভিতরে এসে ভদ্রলােককে চিনতে পারল। দারােয়ান চলে যাওয়ার পর গামছা খুলে ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে বলল, আপনি ব্যাগটা আমার রিক্সায় ফেলে এসেছেন।
জালাল সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাগে কি আছে দেখেছ? সাইফুল বলল, জি, দেখেছি সব পাঁচশাে টাকার নােট।
জালাল সাহেব আরাে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, জেনে শুনে এটা ফেরৎ দিতে এলে কেন? নিয়ে চলে যেতে পারতে?
সাইফুল জ্বীব কেটে বলল, কি বলছেন সাহেব? আপনার টাকা আমি নেব কেন?
সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এখন আমি রিক্সাওয়ালা। তাই বলে বেইমানি করব? তা ছাড়া কোনাে মুসলমানের কি তা করা উচিত? কাল হাশরের ময়দানে আল্লাহপাকের কাছে মুখ দেখাব কি করে? আমার আব্বা-আম্মা আমাকে বেইমানি করার শিক্ষা দেয় নি।
জালাল সাহেব বুঝতে পারলেন, নিশ্চয় ছেলেটা বুনিয়াদি ঘরের । কিছু লেখাপড়াও জানে। তিনি ছেলেটার দিকে ভালাে করে লক্ষ্য করতেই নিজের ছেলে আরজুর কথা মনে পড়ল। আরজু তার একমাত্র ছেলে ছিল। কলেজে পড়তে পড়তে কুংফু শিখত।
কলেজে ইলেকশনের সময় বিপক্ষ পার্টির ছেলেদের ছুরির আঘাতে মারা যায়। তারপর থেকে ওঁর স্ত্রী তাহেরা বেগম অসুস্থ। সাইফুলের মধ্যে তিনি নিজের ছেলের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেন। বললেন, বস, কিছু খেয়ে যাও।
সাইফুল বলল, না সাহেব, আমার দেরি হয়ে যাবে। টাকাগুলাে ঠিক আছে কিনা দেখে।
নিন । কি আছে দেখার জন্যে আমি একবার মাত্র খুলে টাকা দেখে বন্ধ করে ফেলেছি। জালাল সাহেব বললেন, আমি তা বুঝতে পেরেছি। তারপর তিনি ব্যাগ থেকে দুটো পাঁচশাে টাকার নােট বের করে তাকে দিয়ে বললেন, এটা তােমার সততার পুরস্কার।
সাইফুল বলল, মাফ করবেন, আমি টাকা নিতে পারব না।
জালাল সাহেব খুব আশ্চর্য হয়ে বললেন, নেবে না কেন? তুমি আমার এত বড় উপকার করলে, আর আমি তার প্রতিদান দেব না?
সাইফুল বলল, আপনি যদি সত্যি আমাকে কিছু দিতে চান, তা হলে একটা চাকরি দিতে পারেন। এবার যাই, বেশি দেরি হলে আমার রিক্সা চুরি হয়ে যাবে।
জালাল সাহেব একটা ভিজিটিং কার্ড তার হাতে দিয়ে বললেন, তুমি রিক্সাটা জমা দিয়ে এই ঠিকানায় আজই আমার সঙ্গে দেখা কর। দেখি, তােমাকে একটা চাকরি দেয়া যায় কিনা। সাইফুল আনন্দে হাত তুলে সালাম দিয়ে রিক্সা জমা দিতে চলে গেল ।
জালাল সাহেব স্ত্রীর রুমে গিয়ে টাকার ঘটনাটা বলে বললেন, ছেলেটা কুব সৎ ও ধার্মিক। ব্যাগে এত টাকা আছে জেনেও ফেরৎ দিয়ে গেল। তাকে এক হাজার টাকা পুরস্কার দিতে গেলাম, তাও লি না। ছেলেটাকে দেখে আমাদের আরজুর কথা মনে পড়ল। মনে হল, এতদিন পরে যেন আরজু ফিরে এল। ছেলেটা একটা চাকরি চায় ।
তাকে অফিসে আসতে বলেছি। এলে আমাদের কাছে রেখে দেব ভাবছি। তাহেরা বেগম বললেন, ছেরেটাকে দেখতে আমার খুব ইচ্ছা করছে। যদি আসে, তা হলে বাসায় নিয়ে এস।
সাইফুল রিক্সা জমা দিয়ে মতিঝিলে জালাল সাহেবের অফিসে এল। তখন অফিসের ছুটির সময়। জালাল সাহেব তাকে সঙ্গে করে বাসায় নিয়ে এলেন। ড্রইং রুমে বসিয়ে স্ত্রীর কাছে গিয়ে বললেন, ছেলেটা এসেছে, চল দেখবে।
ছেলের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর উনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। পরে জ্ঞান ফিরলেও এক সাইড প্যারালাইজড হয়ে যায়। হাঁটা চলা করতে পারেন না। হুইল চেয়ার ব্যবহার করেন। জালাল সাহেব নিজেই হুইল চেয়ার ঠেলে স্ত্রীকে ড্রইংরুমে নিয়ে এলেন।
তাহেরা বেগম সাইফুলকে প্রশ্ন করে তার পরিচয় এবং ঢাকায় এসে রিক্সা চালাবার কারণ জানতে চাইলেন।
সাইফুল ঝর্ণার ব্যাপার ছাড়া সব কিছু বলল।
তাহেরা বেগম বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে স্বামীকে বললেন, ও এখন ছেলে মানুষ, কি চাকরি করবে? তা ছাড়া পড়াশােনা করার জন্য চাকরি করতে চায়। কিন্তু চাকরি
করতে করতে পড়াশােনা করতে পারলেও ভালাে রেজাল্ট করতে পারবে না। তারচেয়ে এক কাজ কর, ও আমাদের আরজু হয়ে আমাদের কাছে থেকে লেখাপড়া করুক।
সাইফুল সাহেবের স্ত্রীর কথা শুনে অবাক হয়ে ওনাদের দিকে তাকিয়ে দেখল, দু’জনেরই চোখে পানি। জিজ্ঞেস করল, আরজু কে?
জালাল সাহেব চোখ মুছে বললেন, আরজু আমাদের একমাত্র সন্তান ছিল। তাকে আল্লাহ উঠিয়ে নিয়েছেন। তারপর স্ত্রীকে দেখিয়ে বললেন, সেই থেকে অসুস্থ হয়ে গেছে। শুনে সাইফুলের মনে দুঃখ হল। সেই সঙ্গে ফকিরের কথা তার মনে পড়ল।
আল্লাহকে স্মরণ করে সে উঠে এসে প্রথমে জালালসাহেবকে এবং পরে তাহেরা।
বেগমকে কদমবুছি করে বলল আমাকে আপনারা আপনাদের ছেলে মনে করবেন। তাহেরা বেগম তার মাথায় চুমাে খেয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন,
হ্যা, তাই মনে করব বাবা। সে জন্যে বােধ হয় আল্লাহ তােমাকে আমাদের কাছে এনে দিয়েছেন। আমরা তােমাকে আরজু বলে ডাকব।
সেই থেকে সাইফুল আরজু হয়ে তাদের কাছে থেকে লেখাপড়া করতে লাগল। সে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও প্রতিদিন ভােরে কুরআন তেলাওয়াত করে।
তাই দেখে জালাল সাহেব ও তাহেরা বেগম নামায পড়ছেন এবং কুরআন।
তেলাওয়াত করেন। ওনারা সাইফুলকে পেয়ে নিজেদের ছেলের কথা ভুলে গেলেন। তাকে আরজু নামে ডাকেন।
সাইফুল ও ওনাদের স্নেহ বালবাসায় মুগ্ধ হয়ে ওনাদেরকে আব্বা ও আম্মা বলে ডাকে। পরের বছর মনিরার স্বামী সাপের কামড়ে মারা গেল। স্বামী মারা যাওয়ার পর মনিরা দিশেহারা হয়ে পড়ল। কোনাে পুরুষ বলতে ঘরে রইল না। শুধু নাজনীনকে নিয়ে বাস করা মুসকীল হল। মনিরা দেখতে সুন্দরী। এখনাে অটুট স্বাস্থ্য। তার ওপর তার স্বামীর জমিজায়গা বেশি না হলেও নেহাৎ কম না। গ্রামের ছেলে-বুড়াে নিকের
পয়গাম পাঠাতে লাগল। মনিরা তাদেরকে দৃঢ়ভাবে জানাল, সে নিকে করবে না। কিন্তু তারা লােভ সামলাতে না পেরে বারে বারে পয়গাম পাঠাতে লাগল। রাজি না হলে
অনেকে জানের হুমকি পর্যন্ত দিতে লাগল। শেষে মনিরা বাধ্য হয়ে আব্বাকে জানিয়ে এর বিহিত করতে বলল।
ওসমানের আগের মতাে গায়ে ক্ষমতা নেই। ছেলে চলে যাবার পর তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছে। জামাইয়ের গ্রামের লােকদের সঙ্গে গোলমাল না করে সেখানকার সব সম্পত্তি সস্তায় বিক্রি করে দিয়ে মেয়ে ও নাতনিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এল। নাতনির লেখাপড়ার জিদ দেখে তাকে এখানকার স্কুলে ভর্তি করে দিল। ওসমান মেয়ের আবার বিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু মনিরা কিছুতেই রাজি হল না।
ঝর্ণা এস, এস, সিতে তিনটে লেটার নিয়ে ফাস্ট ডিডিশনে পাস করল। তারপর উলিপুর হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ থেকে ভালভাবে আই.এ. পাস করে বাংলায় অনার্স নিয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হল। সে রােকেয়া হলে থাকে।
সাইফুলের একটা বছর নষ্ট হল। সে এস. এস. সি ও এইচ. এস. সি’তে প্রথম। স্থান অধিকার করে ইসলামিক হিস্ট্রীতে অনার্স নিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হল। জালাল সাহেব ও তাহেরা বেগম কলেজে পড়ার সময় সাইফুলকে বার বার
বুঝিয়েছেন, সে যেন কোনাে পার্টি না করে। কারণ জিজ্ঞেস করলে ছেলের কথা বলেছেন। আরজু যে ঘরে থাকত সেই ঘরেই সাইফুল থাকে। সেখানে আরজুর কয়েকটা বড় বড় ফটো দেয়ালে টাঙ্গানাে রয়েছে। সেগুলােতে আরজুর কুংফু প্রাকটিস করার ছবি। তাই দেখে সাইফুল একদিন জালাল সাহেবকে ও তাহেরা বেগমকে বলল, আমি কুংফু শিখব।
জালাল সাহেব বলেন, আজকাল এসব শিখে রাখা ভালাে। দেশের যা অবস্থা, রাস্তাঘাটে যখন তখন খুন, জখম, হাইজ্যাক লেগেই আছে। তবে তুমি যদি প্রতিজ্ঞা কর, ঐসব শিখে সাধারণ মানুষের কোনাে ক্ষতি করবে না, তা হলে আমরা আপত্তি করব না।
সাইফুল তৎক্ষণাৎ প্রতিজ্ঞা করল। তারপর কুংফু ক্লাবে ভর্তি হয়ে লেখাপড়ার সাথে সাথে কুংফু প্রাকটিস করতে লাগল । শেষে সে এত পারদর্শিতা লাভ করল যে, দু’বছরের মধ্যে কংফু মাস্টার খেতাব অর্জন করল। এখন সে ঐ ক্লাবে প্রশিক্ষকের কাজও করে।
জালাল সাহেবের কাছে আশ্রয় পাওয়ার দেড় বছর পর সাইফুল একেবারে এস.এস.সির রেজাল্ট নিয়ে নিজেদের গ্রামে যায় । আব্বা, আম্মা ও বুবুকে সালাম করে তাদের দোয়া নেয়। বােনাইয়ের মৃত্যুর খবর জেনে বুবুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, তােমার কোনাে চিন্তা নেই।
আল্লাহ আমাকে যত দিন বাঁচিয়ে রাখবেন ততদিন
তােমার কোনাে কষ্ট হতে দেব না। তারপর থেকে সে প্রথমে নিজের হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে স্টাইফেনের টাকাসহ প্রতি মাসে আব্বাকে কিছু কিছু পাঠিয়েছে। তারপর কুংফু মাস্টার হওয়ার পর সেখান থেকে যা পায় সেটাও হাত খরচের বাচান টাকার সঙ্গে
আব্বাকে পাঠায়। মাঝে মাঝে দেশে গিয়ে ঝর্ণার খোঁজ-খবর নেয়। সাইফুল যখন
ভার্সিটিতে ভর্তি হল তখন ঝর্ণার অনর্সের সেকেণ্ড ইয়ার চলেছে। সে আগেই ঝর্ণার ভার্সিটিতে পড়ার খবর জেনেছে। এ্যাডমিশন নেয়ার পর দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করে।
কোনাে দিন কাছে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে নি। একদিন লাইব্রেরীতে একটা বই নিতে গিয়ে লাইব্রেরীর বারান্দায় তার সঙ্গে মুখােমুখি দেখা। ঝর্ণা তখন একটা ছেলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে বলতে লাইব্রেরী থেকে বেরােচ্ছে!
ঝর্ণা সাইফুলের নিরুদ্দেশের পর থেকে তার কোনাে খবর জানে না! তাই তাকে আজ এখানে দেখে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সাইফুল বহুদিন তার মানস প্রতিমাকে এত কাছ থেকে দেখে নি । জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ?
ঝর্ণা তখন সাইফুলের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, সাইফুল তা হলে ভার্সিটিতে পড়ছে। আগের সেই রােগা পেঁচকা হাড়গীলে সাইফুল এখন বেশ সুঠাম দেহের অধিকারী। গায়েও দামী প্যান্ট শার্ট। তাকে ভালাে মন্দ খোজ নিতে দেখে তেলে বেগুনের মতাে জ্বলে উঠল। কড়া কিছু বলতে গিয়ে সামলে নিল। আমিনের সামনে কোনাে সিন ক্রিয়েট করতে চাইল না। সংযত হয়ে বলল, সে কথা জেনে তােমার লাভ নেই। তারপর আমিনকে বলল, চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আমিন জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা কে? ঝর্ণা বলল, আমাদের গ্রামের এক ভূমিহীন কৃষকের ছেলে। কারাে দয়ায় হয়তাে লেখাপড়া করছে।
আমিন সাইফুলকে একা বিদ্রুপের হাসি উপহার দিয়ে ঝর্ণার একটা হাত দুলাতে দুলাতে চলে গেল।
সাইফুল মৃদু হেসে লাইব্রেরীতে ঢুকল। এরপর থেকে সে আর ঝর্ণার কাছাকাছি যায় না, দূর থেকে দেখে।
আমিন বড়লােক না হলেও মােটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। তার বাবার ছােট খাট ব্যবসা। বিভিন্ন অফিসে মাল সাপ্লাই দেন। ব্যবসা থেকে যা ইনকাম করেন এবং দোতলা বাড়ির উপরের দু'টো ফ্লাট থেকে যা ভাড়া পান, তাতে সংসারে কোনাে অভাব। নেই । আমিনের সঙ্গে ঝর্ণার পরিচয় ক্লাসমেট হিসাবে। আমিন সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী ।
নিয়মিত ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করে। দেখতেও সুন্দর। পােষাক পরিচ্ছদ কেতা দুরস্ত। বড় বড় কথা বলে ফাট দেখায়। তার সবচেয়ে বড় গুণ সে মেয়েদেরকে কনভিন্স করতে ওস্তাদ। ঝর্ণা সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, পড়াশুনায় ভালাে, তার ওপর।
বড়লােকের মেয়ে। পরিচয়ের পর তাই আমিন তার সঙ্গে প্রেমের খেলা খেলছে।
ঝর্ণার শেষ বর্ষ চলছে। আজ ভার্সিটি বন্ধ। আমিনের কথামত ঝর্ণা বেলা দেড়টার দিকে রােকেয়া হলের গেটের বাইরে এসে আমিনকে দেখতে না পেয়ে অপেক্ষা করতে লাগল । আমিন তাকে আজ চাইনিজ খাওয়াবে। হঠাৎ দেখতে পেল, গেটের পূর্বদিকে অল্প দূরে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে সাইফুল বাদাম কিনছে।
সাইফুল দু'ঠোঙা বাদাম কিনে ঝর্ণার কাছে এগিয়ে এসে একটা ঠোঙা তার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, নাও, বাদাম খাও।
লাইব্রেরীর বারান্দায় ঘটনার পর থেকে প্রায় দেড় বছর হতে চলল ঝর্ণা। সাইফুলকে আর তার কাছে আসতে দেখে নি। মাঝে মাঝে তাকে দূর থেকে লক্ষ্য করতে দেখেছে। তাকে না দেখার ভান করে সরে গেছে। সে সময় ভেবেছে, যার বাপ।
কামলাগিরী করে খায়, সে কিনা ভাগ্যগুণে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে বলে নিজেকে কি ভাবে কি জানি? যদি কোনােদিন আবার সামনে এসে কথা বলার চেষ্টা করে, তা হলে বাছাধনকে টের পাইয়ে ছাড়ব সাইফুলকে দেখেলেই ঝর্ণার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। ঘূণায় রি রি করে উঠে। এখন তাকে বাদাম দিতে দেখে রাগে বারুদের মতাে জ্বলে।
উঠল। বাদামের ঠোঙাটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, তােমার মতাে নির্লজ্জ বেহায়া ছেলে জীবনে দেখি নি। তােমার কি আত্মসম্মান জ্ঞান বলতে কিছু নেই? তুমি তাে জান, আমি তােমাকে ইতর প্রাণীর চেয়ে বেশি ঘৃণা করি। তবু তুমি আমার পিছনে ঘুরাে কেন? তুমি কি নিজের পরিচয় জান না? কোন সাহসে তুমি আমার পিছনে লেগেছে? ভার্সিটিতে লেখাপড়া করছ, কমনসেন্স বলতে তােমর এককণাও নেই। চলে যাও, আর কোনাে দিন আমার সামনে আসবে না।
ঝর্ণা একটা ছেলেকে রাগারাগি করছে দেখে অনেক ছেলেমেয়ে দাড়িয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগে আমিন এসে তার কথাগুলাে শুনেছে। ঝর্ণা তাকে চলে যেতে বলা সত্ত্বেও ছেলেটাকে দাঁড়িয়ে বাদাম খেতে দেখে আমিন এগিয়ে এসে বলল, কি ব্যাপার? তােমাদের গ্রামের সেই ছেলেটা না? ওকি তােমাকে অপমান করেছে? ঝর্ণা বলল, হ্যা। আমার রূপে মুগ্ধ হয়ে আমাকে বাদাম খাওয়াতে চাচ্ছে।
আমিন তাই নাকি বলে সাইফুলের সামনে এসে বলল, এই যে ব্রাদার, সুন্দরী মেয়ে দেখলেই বুঝি জ্বিব দিয়ে লালা পড়ে? ভালই ভালই কেটে পড়ন, নচেৎ কপালে খারাবি আছে। যান চলে যান। আর কোনােদিন কোনাে সুন্দরী মেয়ের পিছনে লাগবেন । ভার্সিটিতে পড়ছেন অথচ ছােটলােকি ব্যবহার ত্যাগ করতে পারলেন না। সাইফুল তার কথায় কান না দিয়ে নির্দিধায় বাদাম খেতে লাগল।
তাই দেখে আমিনের গা জ্বলে উঠল। বলল, কি হল, কথা বুঝি কানে যাচ্ছে না? সাইফুল বলল, সৃষ্টিকর্তা দুটো কান যখন শােনার জন্য দিয়েছেন তখন নিশ্চয় সবকিছু গেছে। তবে এখান থেকে চলে যেতে বলার অধিকার শুধু আপনার একার নয়, সবাইয়ের মতাে আমারও আছে। এ জায়গাটাতাে কারাের নিজস্ব নয়।
আমিন রাগ সহ্য করতে পারল না, তার মুখে একটা ঘুসি মারতে গেল।
সাইফুলের মুখে ঘুসিটা লাগার আগে সে খপ করে তার হাতটা ধরে পিছন দিকে মুচড়ে ধরে রেখে বলল, ঢিল ছুড়লে পাটকেল খেতে হয়। তারপর হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, গায়ে শুধু শক্তি থাকলে হয় না, সেগুলাের প্রয়ােগ করার কৌশলও জানতে হয়। এবার আপনি বরং যান ঝর্ণাকে নিয়ে কোথায় যাবেন । বেচারি অনেকক্ষণ ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমিনের গায়ে প্রচুর শক্তি। কেউ সহসা তার সঙ্গে মারামারি করা তাে দূরের কথা, কথা কাটাকাটি করতে পর্যন্ত সাহস পায় না। সেই আমিন এতগুলাে ছেলেমেয়ে ও ঝর্ণার সামনে একটা একহারা ছেলের কাছে হেরে গিয়ে অপমানে ও রাগে লাল হয়ে গেল। ফুসতে ফুসতে বলল, আমিও দেখে নেব।
সাইফুল মৃদু হেসে বলল, নিজে একা দেখে বুঝি সাধ মিটল না? দলবল নিয়ে দেখতে চান? তাতেও সুবিধে করতে পারবেন না। ওরকম বদ খেয়াল ছেড়ে দিন। মনে রাখবেন আমিও ভার্সিটির ছাত্র।
যারা প্রথম থেকে ঘটনাটা দেখেছে, তারা সাইফুলের দোষ মনে করে আমিনের হয়ে কিছু বলবে বলে ভেবেছিল । কিন্তু তারা সাইফুলের কাণ্ড দেখে ও তার কথা শুনে ভয় পেয়ে চুপ করে রইল।
আমিন বুঝতে পেরেছে ছেলেটা রােগা হলে কি হবে, গায়ে অসুরের শক্তি। সম্মুখ। সমরে তার কিছু করতে পারবে না ভেবে শুধু বলল, আমি এর প্রতিশােধ নেই ।
তারপর ঝর্নাকে বলল, এস অনেক দেরি হয়ে গেল। তারা একটা রিকশায় উঠে চলে যাওয়ার পর নকীব নামে একটা ছেলে সাইফুলকে বলল, আচ্ছা একহাত দেখালেন ভাই। সত্যিই আপনার জওয়াব নেই। আপনার নামটা জানতে পারি?
সাইফুল বলল, নাম জেনে আর কি হবে? তবু যখন জানতে চাইছেন তখন বলাই উচিত, কি বলেন? তারপর সেও একটা রিকশায় উঠে বলল, আমার নাম সাইফুল ।
নকীব নাম শুনে চমকে উঠে হাঁ করে সাইফুলের চলে যাওয়া রিক্সার দিকে চেয়ে রইল । তার অবস্থা দেখে অন্য একটা ছেলে তাকে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার? আপনি ওর নাম শুনে চমকে উঠে অমন করে চেয়ে রয়েছেন কেন?
নকীব বলল, কুংফু মাস্টার সাইফুলের নাম আপনি শােনেন নি? যার নাম কুংফু জগতে বিখ্যাত। আমি ওনার নাম অনেক শুনেছি। কিন্তু চোখে কোনাে দিন দেখি নি। আজ দেখলাম। সত্যি ওনাকে দেখলে কিন্তু সে রকম বিখ্যাত লােক বলে বিশ্বাস হয় না।
ছেলেটা বলল, আমিও ওনার নাম শুনেছি, কিন্তু দেখি নি। আর উনিই যে তিনি, তা আপনি বুঝলেন কি করে? নকীব বলল, দেখলেন না, প্রতিপক্ষের আক্রমণ কত সহজে ব্যর্থ করে কি ভাবে তাকে কুপােকাত করে ফেললেন। ঐ যে ছেলেটা ঘুসি মারতে গিয়েছিল, তাকেও আমি
চিনি। ওনার নাম আমিন । সেরা ব্যায়ামবীর। উনি যেখানে ব্যায়াম করেন, আমিও সেখানে কিছু দিন হল প্রাকটিস করছি। ছেলেটা বলল, আপনার কথা হয়তো ঠিক।
পরের দিন নকীব যখন আমিনকে সাইফুলের কথা বলছিল তখন ঝর্ণা সেখানে ছিল। শুনে সে বেশ অবাক না হয়ে পারে নি। পরে আমিনকে এক সময় বলল, তুমি সাইফুলের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিও না।
কথাটা শুনে আমিনের মনে অনেক প্রশ্ন এসে ভীড় করল। সেগুলােকে প্রশ্রয় না। দিয়ে বলল, গ্রামের চেনা জানা ছেলে। তাই হয়তাে তােমাকে বাদাম খাওয়াতে চেয়েছিল। তাতে তুমি অত রেগে গিয়েছিলে কেন?
ঝর্ণা বলল, তাই বলে আমি তার কাছ থেকে খাব? ও খুব নিচু বংশের ছেলে। ওর বাবা আমাদের ক্ষেতে কামলার কাজ করে। বাদ দাও ওর কথা ।
আমিনের বাবা হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলেন। বাবার ব্যবসা ও সংসারের হাল আমিনকে ধরতে হল। তিন ভাইয়ের মধ্যে আমিন বড়। ছােট দুজনের একজন ইন্টারমিডিয়েট পড়ে। আর অন্যজন ক্লাস সেভেনে। তাই বাধ্য হয়ে লেখাপড়া বন্ধ করে সবকিছু দেখতে হচ্ছে।
মাঝে মাঝে ভার্সিটিতে এসে ঝর্ণার সঙ্গে দেখা করে ।
আমিন বাবার ব্যবসাটা বড় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু ব্যবসার প্রগ্রেস করতে হলে প্রচুর টাকার দরকার। বড় বড় মার্চেন্ট অফিসের টেণ্ডার ধরতে হলে পার্টি দিতে হয়। পার্টি দিয়ে কাজ পেতে হলে প্রচুর টাকার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী ললনা দরকার । আমিন সে সব পাবে কোথায়। কয়েক জায়গায় টেণ্ডার না পেয়ে তার মন
খারাপ হয়ে গেল। কি করে এই প্রবলেম সলভ করা যায়, সেই কথা একদিন শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছিল। হঠাৎ ঝর্ণার কথা মনে পড়তে তার মন বলে উঠল, একে দিয়ে তুমি তােমার প্রবলেম সলভ করতে পারবে এবং একে একে উন্নতির সােপান অতিক্রম করে তােমার মনের বাসনা পূরণ করতে পারবে। কথাটা তার খুব পছন্দ হল। পরের দিন ভার্সিটিতে গিয়ে আমিন ঝর্ণার সঙ্গে দেখা করে বিয়ের প্রস্তাব দিল।
ঝর্ণা বিয়ের কথা শুনে মনে মনে খুব খুশী হল। কিন্তু রাজি হল না। বলল, এত তাড়াহুড়াে করছ কেন? আগে পরীক্ষা দিয়ে নিই, তারপর দেখা যাবে।
আমিন বলল, বিয়ের পরও তুমি পড়াশােনা করতে পারবে। বাবা হঠাৎ মারা। যাওয়ার পর আমাকে তার ব্যবসা চালাতে হচ্ছে। মায়ের শরীর ভেঙ্গে পড়েছে। মা বলছে, এবার একটা বৌ এনে দে। আমি আর তােদের সংসারে ঝামেলা বইতে পারছি না। তাের বাবা বৌ দেখে যেতে পারল না। আমার শরীরের অবস্থাও তেমন ভালাে না।
কবে কি হবে জানি না। মরার আগে আমিও দেখে মরব না? মায়ের কথাটা সে নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য মিথ্যা করে বানিয়ে বলল ।
ঝর্ণা তবু প্রথম দিকে রাজি হল না। বলল, তােমাকে তাে আগে বলেছি, আমার বাবা ভীষণ কড়া লােক । সারা রংপুরে তার খুব নাম ডাক। সে কি এখন আমার বিয়ে দিতে রাজি হবে? তা ছাড়া তাকে এ ব্যাপারে কে বলবে?
ঝর্ণার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর আমিন তাদের বাড়ির সব খবর নিয়ে তার সঙ্গে ভালবাসা করেছে। তার বাবার অবস্থা খুব ভালাে। তিন ভাইয়ের-এক বােন। এক ভাই আবার আমেরিকায় থাকে। ঝর্ণাকে বিয়ে করতে পারলে শ্বশুরের কাছ থেকে অনেক টাকা পয়সা পাওয়া যাবে। তখন আর ব্যবসার উন্নতির পথে কোনাে বাধা থাকবে না।
তাই তাড়াতাড়ি বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। ঝর্ণার কথা শুনে বল, তুমি অত কিছু চিন্তা করছ কেন? আমরা কোট ম্যারেজ করার পর তােমার বাবা মাকে জানাব। প্রথম। প্রথম রাগারাগি করলেও পরে মেনে নেবেন। মায়ের কথা ভেবে তাড়াতাড়ি করছি।
free bangla love story
নচেৎ তােমার কথামতাে তাই করতাম। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বলল, তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না? বিয়ের কথা শুনে বাবা কি করবেন, ঝর্ণা এতক্ষণ সেকথা চিন্তা করছিল।
আমিনের কথা শুনে বলল, বিশ্বাস করব না কেন? ভাবছি বাবার কথা ।
আমিন বলল, ভাবনাটা আমার উপর ছেড়ে দাও। আমি যেমন করে হােক ম্যানেজ করব। তােমাকে দু'একদিনের মধ্যে কোর্ট ম্যারেজ করে ঘরে তুলতে চাই। তাতে তুমি রাজি আছ কিনা বল?
ঝর্ণার তখন সাইফুলের কথা মনে পড়ল। আমিন ভার্সিটিতে পড়াশােনা বন্ধ করার পর সাইফুল তার কাছাকাছি ঘােরাঘুরি করে ।তবে কোনাে দিন কথা বলে নি।
সাইফুলকে দেখলে ঝর্ণার আগে সব সময় রাগ ও ঘৃণা হত। সেদিনের ঘটনার পর সেই সঙ্গে ভয়ও করে। সাইফুলকে জব্দ করার জন্য বলল, বেশ আমি রাজি। তবে ফাইন্যাল পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত বালাকে জানান চলবে না।
আমিন আনন্দে আটখানা হয়ে বলল, সে ব্যাপারে তুমি যা বলবে তাই হবে। তা হলে আগামীকাল আমি বেরা দশটার দিকে আসব।
গতকাল সামার ভ্যাকেসানের ছুটি পড়েছে। আগামীকাল ঝর্ণা দেশে যাওয়ার মনস্থ করেছিল। আমিনের কথা শুনে বলল, বেশ তাই এস।
পরের দিন ঝর্ণা সুপারিন্টেন্টেকে দেশে যাওয়ার কথা বলে হল থেকে বেরিয়ে এল। আমি আগের থেকে গেটের বাইরে অপেক্ষা করছিল। তাকে সঙ্গে করে কোর্টে না গিয়ে কাজী অফিসে গেল।
ঝর্ণা বলল, কোর্টে যাবে না? আমিন বলল, কোর্টে অনেক ঝামেলা। কোর্ট আর কাজী অফিসের মধ্যে পার্থক্য নেই। সেদিন কাজী অফিস থেকে কাবিন করে একদম বিয়ের কাজ সেরে আমিন ঝর্ণাকে নিয়ে বাসায় এল।
আমিন আগেই মাকে বুঝিয়ে বলেছে, ঝর্ণাকে-বিয়ে করলে তার বাবার কাছ থেকে ব্যবসার ব্যাপারে অনেক সাহায্য পাওয়া যাবে। তাই শায়লা বেগম পুত্রবধুকে সাদরে গ্রহণ করে ঘরে তুললেন।
আমিনের বাসায় এসে ঝর্ণার মন খারাপ হয়ে গেল। সে ভেবেছিল, আমিনের বাবা যখন ব্যবসায়ী তখন তাদের বাড়ি ও ঘরের আসবাবপত্র নিশ্চয় খুব উন্নত ধরণের হবে।
কিন্তু দোতলা চারকামরা করে আটকামরা বাড়ি ও নিম্নমানের আসবাবপত্র দেখে তার মন খুঁৎ খুঁৎ করতে লাগল । কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করল না। ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে মনে করে সব কিছু মেনে নেয়ার চেষ্টা করল।
দিন পনের বেশ আনন্দ ফুর্তিতে কেটে গেল। একদিন আমিন ঝর্ণাকে বলল, তােমার এবার দেশে যাওয়া উচিত। কারণ প্রতি বছর সামার ভ্যাকেসানে তুমি বাড়ি যাও। এবারে না গেলে বাড়ির সবাই চিন্তা করবে।
ঝর্ণা বলল, তুমি ঠিক কথা বলেছ । আমিও তােমাকে কথাটা বলব ভাবছিলাম । তা হলে কালকেই তােমার যাওয়ার ব্যবস্তা করে দিচ্ছি। একটা কথা বলি শােন, তুমি গিয়ে মাকে আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা জানিয়ে বাবাকে ম্যানেজ করতে বলবে।
ঝর্ণা আতংকিত হয়ে বলল, না না, তা এখন সম্বব নয়। তােমাকে তাে আগেই বলেছি ফ্যাইন্যাল পরীক্ষার পর জানাব।
সে কথা আমার মনে আছে। তবে কি জান, একটা কন্ট্যাক্ট ধরার জন্যে কিছু টাকার দরকার। কন্ট্যাক্ট ফেল করলে যেমন আমার বহু টাকা লস হবে, সাকসেসফুল।
হলে তেমনি প্রচুর লাভ হবে। এর পিছনে আমি বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা অলরেডী খরচ করে ফেলেছি। বলছিলাম কি, ওনাদের দোয়া নেয়ার পর তুমি যদি বাবাকে বলে লাখ খানেক টাকা ম্যানেজ করতে পারতে, তা হলে ব্যবসাতে তাড়াতাড়ি উন্নতি করতে পারতাম। তা ছাড়া এটাতে আমার ফার্মের ইজ্জৎও জড়িত আছে।
ঝর্ণা বলল, ছি-ছি, এ কথা বলতে তােমার মুখে আটকাল না? কোন মুখ নিয়ে বাবার কাছে টাকা চাইব? এমনিতেই যা ঘটে গেল, সেটা জেনে কি করবেন তার ঠিক নেই।
আমিন বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, তুমি নিজের সম্মান দেখছ, স্বামীর দিকটা চিন্তা করে দেখবে না? এত লেখাপড়া করলে, বুদ্ধি করে সবদিক ম্যানেজ করার চেষ্টা কর।
মেয়েরা স্বামীর জন্য কত অসাধ্য সাধন করে। আর তুমি এই সামান্য কাজটা করতে পারবে না? ঝর্ণার মনের ভিতর থেকে কে যেন বার বার বলছে, ঝর্ণা তুই খুব ভুল করেছিস।
আজকাল মানুষ চেনা খুব কঠিন। এখন আর ভেবে কিছু করতে পারবি না। ভাগ্যকে মেনে নে। চোখে পানি এসে যেতে আঁচলে মুছতে মুছতে বলল, ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করব। ঝর্ণা যখন তাদের দেশের বাড়িতে গিয়ে পৌছাল তখন সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে। সে বাবা-মাকে কদমবুসি করল।
হামিদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুইতাে চিঠিতে লিখেছিলি আরাে পনের দিন আগে আসবি। দেরি দেখে আমরা দুঃশ্চিন্তা করছিলাম। তাের খোঁজ নেয়ার জন্য আবসারকে দু'একদিনের মধ্যে ঢাকায় পাঠাব ভাবছিলাম।
ঝর্ণা জানত তাকে এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাই আগের থেকে উত্তর ভেবে রেখেছে। বলল, পরীক্ষা এগিয়ে আসছে তাই আমরা কয়েকজন বান্ধবী হলে থেকে এজন অধ্যাপকের কাছে টিউটোরিয়াল করছিলাম।
পরের দিন রাত্রে খাওয়ার-দাওয়ার পর ঝর্ণা মাকে তার বিয়ের কথা বলে টাকাটার কথাও জানাল।
মেয়ের কথা শুনে আফসানা বেগম খুব অবাক হয়ে তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর আতঙ্কিত স্বরে বললেন, এ তুই কি বলছিস, আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না?
ঝর্ণা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, হ্যা মা, এটাই তােমাকে বুঝতে হবে এবং বাবাকেও বােঝাতে হবে।
আফসানা বেগম মেয়েকে কাঁদতে দেখে বললেন, তুই একবারও তাের বাবার ইজ্জতের দিকে তাকালি না। সে কি এ বিয়ে মেনে নিতে পারবে? রংপুরের ম্যাজিস্ট্রেট তাের বাবার বন্ধু । তার ছেলে বিলেত থেকে লেখাপড়া শেষ করে এ বছর ফেরার কথা। তার সঙ্গে তাের বিয়ের কথাবার্তা একদম ফাইন্যাল হয়ে আছে। সব কিছু জেনে কি করে আমি তাকে তাের কথা জানাব?
ঝর্ণা কাঁদতে কাঁদতে বলল, এখন আর সে কথা বলে লাভ কি? তােমরা আমাকে এতদিন সে কথা জানাও নি কেন? আমার ভাগ্যে যা ছিল হয়েছে। তােমরা আমার ভাগ্যকে কি বদলাতে পারবে?
আফসানা বেগম কি করবেন ভেবে ঠিক করতে পারলেন না।
ঘুমাবার সময় স্ত্রীর থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে হামিদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? তােমার কি শরীর খারাপ না, আমার কিছু হয় নি।
তােমাকে দেখে তাে তা মনে হচ্ছে না। আফসানা বেগম সাহস সঞ্চয় করে বললেন, তােমার মেয়ের খবর শুনলে তােমারও তাই হবে।
হামিদ সাহেব কপাল কুচকে বললেন, তার আবার কি খবর?
তােমার মেয়ে ভালবাসা করে বিয়ে করেছে। ছেলেটার বাপের কি ব্যবসা ছিল। সে মারা যেতে ছেলে সেই ব্যবসা চালাচ্ছে। ব্যবসার জন্যে তার লাখ খানেক টাকা দরকার। সেই জন্যে তােমার মেয়ে এসেছে। সে এসে যে কথা বলেছে তা মিথ্যে।
হামিদ সাহেব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। হতবাক হয়ে চিন্তা করতে লাগলেন, আমার মেয়ে হয়ে এরকম কাজ করবে তাও কি সম্ভব? আবার চিন্তা করলেন, সে যখন নিজের মুখে বলেছে, তখন তাে বিশ্বাস করতেই হয়। তারপর খুব রাগের সঙ্গে বললেন, এ বিয়ে আমি কখনাে মেনে নিতে পারব না। আমার মান ইজ্জৎ সব যাবে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে আমি কোন মুখে একথা জানাব? ডাক তাকে, তার। মুখে আমি শুনতে চাই।
আফসানা বেগম মেয়েকে ডেকে নিয়ে এলেন। ঝর্ণা মায়ের সঙ্গে এসে জড়সড় হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল।
হামিদ সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, তাের মাকে যা বলেছিস তা কি সত্যি? ঝর্ণা ভয়ে কথা বলতে পারল না। মাথা নিচু করে চুপ করে কাপতেই লাগল। কি হল কিছু বলছিস না কেন?
ঝর্ণা কোনাে রকমে কাঁপা গলায় বলল, জি, সত্যি।
হামিদ সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন, স্বীকার করতে তাের লজ্জা করল না। বড় আশা করে উচ্চ শিক্ষা নেয়ার জন্য তােকে ভার্সিটিতে ভর্তি করেছিলাম। আর তুই কিনা এমন জঘন্য কাজ করলি? যার ফলে আমি কারাে কাছে মুখ দেখাতে পারব না। কোথাকার।
কেমন ছেলে, কার ছেলে, তা জানাবার দরকারও মনে কবলি না? যে ছেলে বিয়ের পরপর স্ত্রীকে টাকার জন্য তার বাবা-মার কাছে পাঠায়, সে কি ধরণের ছেলে আমার জানা আছে।
তাের যদি বুদ্ধি থাকত, তা হলে বুঝতে পারতিস, আমাদের সব কিছু জেনে তােকে টাকা কামাবার টোপ হিসাবে ব্যবহার করবে বলে বিয়ে করেছে। তুই না বুঝতে পারলেও আমি পেরেছি। তারপর স্বর নামিয়ে বললেন, খুব ভুল করে ফেলেছি। মা । যাক যা হবার
হয়েছে; তাের আর ফিরে যাওয়ার দরকার নেই। আমি ডিভাের্সের জন্য উকিলি চিঠি পাঠিয়ে দিচ্ছি। মনে হয় লাখ দু'য়েকের মধ্যে মিটমাট করে ফেলতে পারব।
বাবার স্বর নরম হতে দেখে ঝর্ণা সাহস করে বলল, তা হয় না বাবা। আমি তােমার সঙ্গে একমত নই। সে আর যাই হােক অত ছােট নয়।
হামিদ সাহেব মেয়ের কথা শুনে আবার রেগে গেলেন। তবু সংযত হয়ে গম্ভীরস্বরে বললেন, তুই এত লেখাপড়া করলে কি হবে, মানুষ চেনার জ্ঞান তাের এখনও হয়নি। আমি যা বললাম তাই হবে।
ঝর্ণা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আমি তা মেনে নেব না। যাকে ভালবেসে বিয়ে করেছি, তাকে বাদ দিয়ে অন্য ছেলেকে আবার বিয়ে করতে পারব না। বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করব, তবু তা পারব না।
হামিদ সাহেব এতক্ষণ অনেক ধৈৰ্য্য ধরে ছিলেন, এবার সীমার বাইরে চলে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, তা হলে তুই জাহান্নামে যা, আমি আর তাের মুখ দেখতে চাই না। কাল যেন তাের ঐ মুখ আমি আর না দেখি। দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে। বিষ খেয়ে মর আর সেই ছােটলােকের ঘরে ফিরে যা, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তােকে আমার মেয়ে ভাবতে ঘৃণা হচ্ছে। এক্ষুনি বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে। আর কোনােদিন এ মুখাে হবি না ।
বাবার কথা শুনে ঝর্ণার মনে প্রচণ্ড আঘাত লাগল। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, হ্যা, তাই চলে যাব বাবা। আর কোনােদিন তােমাদের কাছে আসব না। কথা শেষ করে সে ছুটে বেরিয়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা খিল দিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।
আফসানা বেগম মেয়েকে বোেঝাবার জন্য তার পিছনে যেতে উদ্দত হলে হামিদ সাহেব জোর গলায় বললেন, তুমি ওর কাছে যাবে না। গেলে তােমাকেও চিরকালের জন্য এ ঘর ত্যাগ করতে হবে।
আফসানা বেগম স্বামীর রাগ জানেন, চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, মেয়েটা যদি কিছু অঘটন ঘটিয়ে ফেলে? হামিদ সাহেব বললেন, অঘটন যা ঘটাবার তা তাে ঘটিয়েই ফেলেছে, আবার কি ঘটাবে? আফসানা বেগম আর কিছু না বলে বসে পড়লেন।
হামিদ সাহেব অনেক বছর ধরে ধলিবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। আর্থিক অবস্থা খুব ভালাে।
ওনার তিন ছেলে এক মেয়ে । তিন ছেলেই গ্রাজুয়েট। বড় ছেলে আসার চাষবাস দেখাশােনা করে। বিরাট ইরি প্রজেক্ট আছে। মেজ ছেলে মারুফ রংপুর টাউনে একটা পাঁচতলা আবাসিক হােটেল করে সেটা পরিচালনা করে। ছােট ছেলে সবুজ আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষা নিতে গিয়েছিল । শিক্ষা শেষে চাকরি করতে করতে একজন আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করে সেখানেই থাকে। ঝর্ণা সকলের ছােট।
ঝর্ণা সারা রাত কেঁদে কাটাল। অনেকবার চিন্তা করেছে, গলায় ফাঁস দিয়ে। আত্মহত্যা করবে। পরক্ষণে ভেবেছে এখানে আত্মহত্যা করলে বাবাকে আরাে অপমানিত হতে হবে। যদি একান্ত করতে হয়, ঢাকাতে গিয়েই করবে। ভােরে কেউ জাগার আগে সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। ঢাকায় আমিনদের বাসায় যখন পৌছাল তখন রাত আটটা। আমিন তখনও বাসায় ফিরে নি।
শায়লা বেগমবৌ-এর চেহারা দেখে যা বােঝার বুঝে গেলেন। আমিন অনেক রাত্রে ফিরে সব কিছু শুনে বেশ কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। তারপর বলল,তােমার চলে আসা উচিত হয় নি। বাবা-মাকে না জানিয়ে বিয়ে করলে সব বাবা-মাই ঐ রকম
বকাবকি করেন। কয়েকদিন থাকা তােমার উচিত ছিল। থাকলে দেখতে, রাগ পড়ে গেলে তারা কিছু একটা ব্যবস্থা করতেন। কিছুদিন যাক, ওনাদের রাগও পড়ক। তখন। গেলে আর এ রকম করবেন না। জামাই এর ব্যবসার জন্য টাকার দরকার ভেবে। নিজেরাই টাকাটা দিয়ে দেবেন।
ঝর্ণার মন এমনিই খারাপ, তার উপর এরকম কথা শুনে তার মনে খুব কষ্ট হল। বলল, আমি মরে গেলেও সেখানে আর যাব না। এত কিছু হয়েছে জেনেও যেতে বলছ। কি করে?
আমিন বলল, তা হলে এক কাজ কর, তােমার এক ভাই তাে আমেরিকায় থাকেন, তার কাছে চিঠি দিয়ে টাকাটার ব্যবস্থা করতে বল ।
ঝর্ণা যেন ক্রমশ আমিনের আসল মতলব বুঝতে পারছে। তখন তার বাবার কথা মনে পড়ল- ‘ছেলেটা টাকা কামাবার টোপ হিসাবে ব্যবহার করবে বলে তােকে বিয়ে করেছে।' বেশ রাগের সঙ্গে বলল, তাও আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আচ্ছা, একটা ব্যাপার।
বুঝতে পারছি না, আমাদের বিয়ের এখনও একমাস হয় নি; এরই মধ্যে আমার বাবাভাইদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছ কেন? আমিনের ঠোটে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। বলল, বুঝবে, আস্তে আস্তে সব বুঝবে। এখন ও কথা বাদ দিয়ে তােমার বাবা বা আমেরিকার ভাইয়ের কাছ থেকে যত তাড়াতাড়ি পার টাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এবার চল খেতে দেবে। ভার্সিটি খােলার পর ঝর্ণা ক্লাস করার কথা আমিনকে বলল।
আমিন বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, মেয়েদের বেশি লেখাপড়া করে লাভ কি শুনি? যতই উচ্চডিগ্রী নিক না কেন, সংসারের কাজ ও ছেলে-পুলে মানুষ করা তাদেরকে করতেই হবে। তবু যদি তােমার সখ হয়, তা হলে বাবা-ভাইদের কাছ থেকে মালপানি আনার ব্যবস্থা কর। তারপর না হয় দেখা যাবে।
বিয়ের আগে কি বলেছিলে মনে নেই?
মনে থাকবে না কেন? জান না বুঝি, বিয়ের আগের কথা বিয়ের আগে পর্যন্ত ঠিক থাকে। বিয়ের পরে আর সেগুলাের কোনাে মূল্য থাকে না, বাসি ফুলের মতাে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হয়। ওসব পুরােন প্যাচাল বাদ দিয়ে টাকার ব্যবস্থা কর। এরপর থেকে ঝর্ণার জীবনে কালাে ছায়া নেমে এল। মাস দুয়েক স্বামী, শাশুড়ী অনেক বুঝিয়ে ও ভয় দেখিয়ে যখন ঝর্ণাকে দিয়ে টাকা আদায় করাতে পারল না তখন তারা তার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করতে লাগল ।
স্বামী-স্ত্রী একরুমে থাকলেও খাট আলাদা, শুধু রাতে দৈহিক সম্পর্ক ছাড়া আর কোনাে সম্পর্ক নেই। আমিন প্রয়ােজন ছাড়া তার সঙ্গে কথা বলে না। প্রয়ােজনের কথাগুলােও খুব গরম মেজাজে বলে। শাশুড়ীও তাকে একদম দেখতে পারেন না। সংসারের সব কাজ তাকে দিয়ে করান।
কাজের খুঁৎ ধরে মােটা মােটা কথা শােনান। বাপের বাড়ি থেকে কিছু আনতে পারে নি। বলে যখন তখন খোটা দেন। ঝর্ণা ভাগ্যের কথা ভেবে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সব কিছু সহ্য করে যাচ্ছে।
একদিন বিকেলে আমিন বাসায় ফিরে হাসি মুখে ঝর্ণাকে বলল, বিয়ের পর থেকে কাজের চাপে তােমাকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে পারি নি। আজ এক বন্ধু পার্টি দিচ্ছে, সেই পার্টিতে তােমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক অনুরােধ করে বলেছে।
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় পার্টি শুরু হবে। আমরা সাতটার সময় বেরােব। তারপর ব্রীফকেস খুলে একটা প্যাকেট বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, তােমাকে তাে আজ পর্যন্ত কোনাে ভালাে জামা-কাপড় দিই নি । তাই এগুলাে কিনে আনলাম। বন্ধুর পার্টিতে তাে আর যা-তা পরে যাওয়া যায় না।
অনেক দিন পর স্বামীকে হাসি মুখে কথা বলতে দেখে ও তাকে পার্টিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য দামী কাপড় কিনেছে দেখে ঝর্ণা মনে মনে খুশী হলেও বাইরে তা প্রকাশ করল না। শুধু একটু ম্লান হাসি হেসে বলল, আমার সৌভাগ্য।
পার্টি বলতে কি বােঝায় ঝর্ণা আগে তা জানত না। এখানে এসে যেন আজ আর একটা জগৎ দেখল। পার্টিতে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া সবাই আছে। আমিন তার বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে একটু পরে আসছি বলে সেই যে গেছে, এক ঘন্টা পার হয়ে গেল, তবু তার পাত্তা নেই। স্বামীর বন্ধুকে ঝর্ণার খুব অভদ্র বলে মনে হল। কথা বলার সময় নানান ছুতােয় গায়ে হাত দিচ্ছে। একবার তাে বলেই ফেলল, আপনার মতাে এত সুন্দর ফিগারের মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি।
আপনার ভাবি ভিতরে আপ্যায়নের কাজে ব্যস্ত আছে এলে পরিচয় করিয়ে দেব। দেখবেন, সেও সুন্দরী। তবে আপনার মতাে এত সুন্দর ফিগার তার নয়। এই রকম ফিগার না হলে বিছানায় আনন্দ পাওয়া যায় না। পরিচয়ের সময় তার। হুদা বলেছিল। এখন তার নির্লজ্জ ব্যবহার ও কথাবার্তা দেখে শুনে ঝর্ণার মনে হল, লােকটার নাম বেহুদা হলে ঠিক হত ।
পার্টির কাজ শেষ হতে রাত দশটা বেজে গেল। খাওয়া-দাওয়ার পর সবাইকে মদ খেতে দেখে ঝর্ণা খুব অবাক হল। এক ফাঁকে হুদা তার গিন্নীকে নিয়ে এসে ঝর্ণার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। তার নাম মিলি। ঝর্ণার মনে হল, মিলি তার থেকে কম সুন্দরী নয়। ডানা কাটা পরীর মতাে। সবাইর সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। শাড়ি-ব্লাউজ যেভাবে পরেছে, তাতে করে সবাই তার দিকে লােলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। সেদিকে মিলির কোনাে খেয়াল নেই। সবাইকে নিজের উদভ্রান্ত যৌবন দেখিয়ে বেড়ানই যেন।
তার প্রধান কাজ। পাতলা ফিনফিনে জর্জেটের শাড়ি পরনে, গায়ে তিন ইঞ্চি বহরের সাণ্ডো ব্লাউজ। ফর্সা ধব ধবে প্রায় গােটা পিঠটা দেখা যাচ্ছে। ব্লাউজের কাপড় এত পাতলা যে, ব্রা দেখা যাচ্ছে। ব্রাটা এমনভাবে পরেছে, যার ফলে তার সুউচ্চ উন্নত বক্ষ দুটো অর্ধেক বেরিয়ে রয়েছে। বুকের ওপরকার শাড়িটা সরে গিয়ে দুই পাহাড়ের গিরীপথ দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে জর্জেটের শাড়িটা বুক থেকে খসে পড়ে যাচ্ছে।
সেটাকে বেশি সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে যথাস্থানে রাখছে। ঝর্ণার মনে হল, মিলির যৌবন। দেখবার জন্য যেন এই পার্টির আয়ােজন। আর একটা জিনিস সে লক্ষ্য করল, পার্টির প্রধান অতিথিকে নিয়ে যেন মিলি বেশি ব্যস্ত। আর তার স্বামী অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে বেশ হাসাহাসি করছে। রাত যত বাড়তে লাগল, তত যেন পার্টির রং বদলে যেতে লাগল। এক সময় বড় বাতি অফ করে গাড় নীলাভ বাতি জ্বেলে দেয়া হল। ঝর্ণার গা ছম ছম করে উঠল।
গােটা রুমটা কুয়াসার মত আচ্ছন্ন হয়ে গেল। কারাে মুখ চেনা যাচ্ছে না। নারী-পুরুষ যেন মিশে এক হয়ে যাচ্ছে। কে কাকে জড়িয়ে ধরছে সেদিকে কেউ লক্ষ্য করছে না, আর বাধাও দিচ্ছে না। ঝর্ণা এইসব দেখে খুব ব্ৰিত বােধ।
করছিল। হঠাৎ একজন প্রৌঢ় ভদ্রলােক এসে তার হাত ধরে বলল, আপনি একা কেন? আসুন একটু ফুর্তি করি । ঝর্ণার গােটা শরীরটা ঘৃনায় রি রি করে উঠল। ঝটকা মেরে আমিনের বলিষ্ঠ হাতের চড় খেয়ে ঝর্ণার মাথা ঘুরে গেল। গালটা ব্যথায় টনটন। করে উঠল। তার চোখ দুটো দিয়ে পানি পড়তে লাগল। গালে হাত বুলাতে বুলােতে ভাবল, আমিন যে এত নিচ, এত ছােটলােক, তা আগে বােঝা উচিত ছিল। বারবার।
তার বাবার কথা মনে পড়তে লাগল। তখন যদি বাবার কথামতাে আর ফিরে না আসত, তা হলে কত ভালাে হত। অনুশােচনায় তার মন খুব ভেঙ্গে পড়ল। ড্রেস চেঞ্চ করার কথা ভুলে গিয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।
প্রায় দু'বছর হতে চলল, শত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও শংকর মাছের চাবুকের মার খেয়ে তাকে বিভিন্ন পার্টিতে যেতে হচ্ছে। ঝর্ণা ক্রমশঃ অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। অনেকবার ভেবেছে, আত্মহত্যা করে এই পংকিল জীবনের অবসান ঘটাতে। কিন্তু পারে নি। শুধু ভাবে কি করে এই দুর্বিসহ জীবন থেকে পরিত্রাণ পাবে। কোনাে উপায় দেখতে না পেয়ে রাতকে রাত কেঁদে কাটাচ্ছে।
এদিকে আমিনের ব্যবসা দিনে দিনে ফুলে ফেঁপে উঠছে। গাড়ি কিনেছে। ঘরের পুরােন আসবাবপত্র বিক্রি করে নতুন কিনেছে। আগে পার্টিতে মদ খেত। এখন পুরাে মদখাের হয়েছে। প্রতিরাতে মদ খেয়ে ঝর্ণার উপর অত্যাচার করে। এবার সে একটা খুব বড় কন্ট্যাকের জন্য পার্টি দেবে। সে কথা একদিন ঝর্ণাকে জানিয়ে বলল, প্রথম যেদিন আমার বন্ধুর পার্টিতে তােমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেই পার্টিতে বন্ধুপত্নী যে ডাইরেক্টরের মন যুগিয়ে অর্ডার বাগিয়েছিল, তার সঙ্গে এবারে আমি কন্ট্যাক্ট করেছি।
এবারের অর্ডার দশলাখ। এটা যদি তুমি বন্ধুপত্নীর মতাে বাগাতে পার, তা হলে তুমি যা চাইবে তাই দেব।
ঝর্ণা শুনে চমকে উঠে ভাবতে লাগল, এতদিন সে নানান ছলচাতুরি করে নিজের ইজ্জৎ বাচিয়ে সব কাজ হাসিল করেছে। কিন্তু যে লােককে মিলি দেহ দিয়ে কাজ আদায় করেছে, তাকে দেহ না দিয়ে কি সে সাকসেসফুল হতে পারবে? লােকটাকে সেদিন দেখে মনে হয়েছে, বয়স হলে কি হবে, ভীষণ কামুক। মেয়েদের দিকে কি রকম লােভাতুর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। তার উপর মদখাের।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আমিন জিজ্ঞেস করল, কি ভাবছ? কিছু বললে না যে? ঝর্ণা রাগের সঙ্গে প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল। সামাল নিয়ে বলল, কি আর ভাববাে, তকদিরের কথা ভাবছিলাম
আমিন বলল, তকদিরকে মেনে নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ। আমিন যেদিন অফিসে পার্টি দিবে, সেদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় ঝর্ণাকে বলল, সন্ধ্যের আগে রেডী হয়ে থেক, এসে নিয়ে যাব। আজ আমার শরীর খারাপ, পার্টিতে যেতে পারব না।
আমিন বিরক্ত হয়ে বলল, যাব না বললেই হল, ওসব বাজে অজুহাত বাদ দিয়ে যা বললাম তাই করাে । তারপর সে বেরিয়ে গেল।
ঝর্ণা সারাদিন চিন্তা করল, কি করবে? না গেলে আমিন নিশ্চয় খুব মারধর করবে। আর গেলে কি ইজ্জৎ বাঁচাতে পারবে? আজকাল শিক্ষিত সমাজে মদ আর মেয়ে মানুষ যেন একটা ফ্যাশানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এরা কেমন শিক্ষিত? ব্যবসা করে টাকা কামনর
জন্য নিজের বৌদের ইজ্জৎ বিলিয়ে দিতে দ্বিধাবােধ করে না। বরং গর্ববােধ করে। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল, আজ পার্টিতে যাবে না। তাতে কপালে যা আছে তাই হবে। | সন্ধ্যের সময় আমিন বাসায় ফিরে ঝর্ণাকে তৈরি থাকতে না দেখে বলল, কি। ব্যাপার, এখনও তুমি তৈরি হও নি? ঝর্ণা স্বামীর দু’পা জড়িয়ে ধরে বলল, মাফ কর, আজ পার্টিতে যেতে পারব না।।
love story
আমিন পা দিয়ে তাকে ঠেলে দিয়ে রাগের সঙ্গে বলল, ওসব প্যানপ্যানানি আমি পছন্দ করি না। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। ঝর্ণাকে বসে কাঁদতে দেখে আমিন তার। হাত ধরে তুলে বলল, তুমি না গেলে আজ যেমন আমার ইজ্জৎ ধুলাের সঙ্গে মিশে যাবে, তেমনি দশলাখ টাকার অর্ডারটাও হাত ছাড়া হয়ে যাবে। ভালাে চাওতাে যা বললাম করাে, নচেৎ শংকর মাছের চাবুক দিয়ে যা করার করব। শংকর মাছের চাবুকের কথা শুন ঝর্ণার মুখ বির্বণ হয়ে গেল।
আগে এক পার্টিতে যাওয়ার দিন সত্যি সত্যি ঝর্ণার শরীর খারাপ ছিল। সেই জন্যে পার্টিতে যেতে চাইনি। সেদিন আমিন তাকে সদ্য কিনে আনা শংকর মাছের চাবুক দিয়ে ধােলাই করেছিল। সেই ধােলাই খেয়ে কয়েকদিন ঝর্ণাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল। সমস্ত শরীর ফেটে ।
গিয়ে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল। এখনও মারের দাগ আছে। সেই মারের কথা মনে পড়তে। শেষমেষ ঝর্ণা পার্টিতে গেল। স্বামীর বন্ধুপত্নী মিলির মতাে ব্যবহার সবাইয়ের সঙ্গে করতে পারল না। কিন্তু খুব চালাকির সঙ্গে ডাইরেক্টরকে পটিয়ে কাজ আদায় করেছে। পাটিতে। অনেক ছলাকলা দেখিয়ে ইজ্জৎ রক্ষা করেছে বটে, কিন্তু দু'চারজন
আলাপ করতে করতে। কাছে টেনে নিয়ে দু'একটা চুমাে খেতে ছাড়ে নি। ঝর্ণা ভাবল, আমিনের কথামতাে সে যদি মদ খাওয়া অভ্যাস করত, তা হলে সে ইজ্জৎ বাচাতে পারত না। বাসায় ফিরে আমিন খুশীতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কয়েকটা চুমাে খেয়ে বলল, তুমি আজ যা করলে, তার জওয়াব নেই। বল কি উপহার চাও? যা চাইবে তাই দেব।
আমিন তাকে জড়িয়ে চুমাে খেতে ঝর্ণার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘৃণায় ভরে গেল। ভাবল, পার্টিতে স্ত্রীর এই গালে কত লোেক চুমাে খেয়েছে জেনেও স্বামীর কোনাে। প্রতিক্রিয়া নেই। নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে ম্লান হেসে বলল, যে নিঃস্ব সে আবার অন্যকে কি দেবে? আমিন কপাল কুচকে বলল, কথাটা বুঝলাম না? ঝর্ণা বলল, বােঝার আর দরকার নেই। আমি এখন ঘুমাব। বড় ক্লান্তি লাগছে।
আমিন জানে পার্টিতে ঝর্ণার খুব ধকল গেছে। তাই তার কথা শুনে আর কিছু বলল না। ড্রেস চেঞ্জ করার সময় শুধু বলল, যার কাছ থেকে তুমি অর্ডারটা সই করিয়ে। নিলে ওনার নাম আজিজ সাহেব। উনি কি বললেন জান? বললেন, আপনার ওয়াইফ যেমন সুন্দরী তেমনি বুদ্ধিমতী।।
আমিনের কথা শুনে ঝর্ণার পার্টির কথা মনে পড়ল। সবাইয়ের কাছ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে যখন আজিজ সাহেবের কাছে সই করাবার জন্য ফাইলটা খুলে ধরল। তখন তিনি বললেন, ওটা তাে হবেই। তবে এখানে নয়, পাশের রুমে চলুন। আগে। একটু ফুর্তি করে নিই বলে তার একটা হাত ধরে উঠে দাঁড়ালেন। ঝর্ণা সরে এসে তার গা ঘেঁসে বলল, এত লােকজনের মধ্যে দিয়ে পাশের রুমে গিয়ে জুৎসই ফুর্তি করা যাবে না। কিছু হলেও শান্তি পাওয়া যাবে না। তার চেয়ে।
আপনি সময় সুযােগ মতাে কোনাে হােটেলে অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে আমাকে জানাবেন। তখন আর আপত্তি করব না। আজিজ সাহেব তাকে শুধু একটা চুমাে খেয়ে মুচকি হেসে বললেন, আপনি শুধু সুন্দরী নন, বুদ্ধিমতীও। তারপর ফাইলটা নিয়ে অর্ডারে সই করে দেন। এখন স্বামীর কাছে আজিক সাহেবের সেই কথা শুনে ঝর্ণা মনে মনে ভয় পেলেও ঠোটে হাসি ফুটিয়ে বলল, আজিজ সাহেব যাই বলুন না কেন, তুমি কি মনে কর? আমিন হেসে উঠে বলল, আমি তােমাকে তাই জেনেই তাে ভালবেসে বিয়ে করেছি।
আমিনের মুখে ভালবাসার কথা শুনে ঝর্ণার আবার ঘনায় মনটা ভরে গেল। বলল, আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, ঘুম পাচ্ছে। বেশ কিছুদিন পর একদিন আমিন অফিস থেকে এসে বলল, আজিজ সাহেব কাল।
একটা পার্টি দিচ্ছেন। আজ ফোনে সে কথা জানিয়ে আমাদেরকে নিমন্ত্রণ করলেন। কথাটা শুনে ঝর্ণা চমকে উঠে বলল, আমি উনার পার্টিতে যেতে পারব না, তুমি। একা যেও। কেন? কেন আবার। সেদিন অনেক কষ্টে ওনার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছি। এবারে তিনি ছেড়ে কথা বলবেন না। ঐ সব নােংরামী জান গেলেও আমি করতে পারব না। ননাংরামী কাজ না করেও তাকে তুমি সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করবে। আমি কি তােমাকে নােংরামী করতে বলেছি?
ডাইরেক্ট না বললেও আমাকে দিয়ে যে কাজ করাচ্ছ, তাতে বােঝা যায়, ইনডাইরেক্ট বলছ। আমিন রেগে উঠে বলল, আমি তােমার অত কথা শুনতে চাই না। কাল তুমিও আমার সঙ্গে আজিজ সাহেবের পার্টিতে যাবে। যদি না যাই? তার পরিণতি তুমি জান ।। জানলেও যাব না। ঠিক আছে, কাল দেখা যাবে।
পরের দিন আমিন ঝর্ণাকে যাওয়ার জন্য প্রথমে অনেক বােঝাল। তাতে রাজি না। হতে রেগে গিয়ে গালাগালি করল। তারপর শংকর মাছের চাবুক দিয়ে আঘাতের পর। আঘাত করতে করতে বলল, আজ না গেলে সেই দশলাখ টাকার অর্ডারটা ক্যান্সেল। হয়ে যাবে। যদি আমার কথামতাে কাজ না করতে পারিস, তা হলে এক্ষুনি বেরিয়ে যা। যে স্ত্রী স্বামীর উন্নতি চায় না, তেমন স্ত্রী থাকার চেয়ে না থাকাই ভালাে। ঝর্ণা জানত, পার্টিতে না গেলে আমিন মারধর করবে।
কিন্তু এরকমভাবে ছােটলােকের মতাে ভাষা ব্যবহার করে গালাগালি করে এতবেশি মারবে তা ভাবতেই পারে নি। কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি এ মুখ নিয়ে কোথায় যাব? তার চেয়ে মারছ। যখন, তখন একদম শেষ করে দাও। নচেৎ বিষ এনে দাও, খেয়ে নিজেও শান্তি পাব।
আর তুমিও পাবে। তার আগে শুনে রাখ, তুমি এত নীচ, এত ছােটলােক, এত ইতর, আগে যদি জানতে পারতাম, তা হলে ... বলে মারের যন্ত্রণায় কঁকাতে লাগল।
তার কথা শুনে আমিন আরাে উত্তেজিত হয়ে বলল, তা হলে কি করতিস? তা হলে বুঝি তাের গ্রামের সেই সাবেক প্রেমিক সাইফুলকে বিয়ে করতিস?।
ঝর্ণা রেগে বলে উঠল, হ্যা তাই করতাম।। | তবে রে হারামজাদী বলে আমিন তাকে আবার মারতে লাগল। এক সময় ক্লান্ত হয়ে চাবুকটা যথাস্থানে রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলল, ফিরে। এসে তােকে যেন আর না দেখি।
মার খেতে খেতে ঝর্ণার প্রায় মুচ্ছা যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আমিন বেরিয়ে। যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ ঘরের মেঝেয় পড়ে কাঁদল। তারপর টলতে টলতে বাথরুম থেকে মুখ-হাত ধুয়ে এসে যে জামা কাপড় পরে এ বাড়িতে প্রথম এসেছিল, সেটা পরে। নিঃস্ব হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল। কোথায় যাবে চিন্তা করে ঠিক। করতে না পেরে শুধু হেঁটেই চলল। কতক্ষণ হেঁটেছে তার খেয়াল নেই। সে খুব আনমনা অবস্থায় হাঁটছিল। সামনে থেকে একটা প্রাইভেট কার তাকে চাপা দেয় দেয়।
অবস্থায় পাশ কাটিয়ে চলে গেল। গাড়ীর হর্ণ ও তীব্র আলােয় ঝর্ণার সম্বিত ফিরে এল। বুঝতে পারল, সে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছে। তাড়াতাড়ি ফুটপাতে উঠে ধীরে ধীরে। যেতে যেতে ভাবল, এই রাতের বেলা কোথায় যাওয়া যায়? হঠাৎ করে বান্ধবী শিরীনের। কথা মনে পড়ল। অনার্স পড়তে পড়তে এক ডাক্তারের সঙ্গে তার বিয়ে
হয়ে যায়। বিয়ের পর একদিন হলে এসে তাকে বাসায় নিয়ে গিয়ে তার স্বামীর সঙ্গে পরিচয়। করিয়ে দিয়েছিল। সেখানে যাওয়ার মনস্থির করে একটা রিক্সায় উঠে ঠিকানা বলল। আমিনের বাসা বক্সিবাজারে। ঝর্ণা সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে গুলিস্থান চলে এসেছিল। শিরীনরা আজিমপুরে একটা ফ্লাটে থাকে। কিছুদূর আসার পর মনে
পড়ল। তার কাছে টাকা নেই, ভাড়া দেবে কি করে? ভাবল, রিক্সাওয়ালাকে সে কথা বলে নেমে যাই। আবার ভাবল, এতদূর কি এই অবস্থায় হেঁটে যেতে পারবে? তা ছাড়া রিক্সাওয়ালাই বা কি মনে করবে? শেষে ভাবল, শিরীনের কাছ থেকে নিয়ে দেবে। বাসায় পৌছে ঝর্ণা রিক্সাওয়ালাকে বলল, একটু দাঁড়াও ভাই, ভাড়া পাঠিয়ে দিচ্ছি।
রিক্সাওয়ালা কি আর বলবে, এরকম প্যাসেঞ্জার সে অনেক দেখেছে। বলল, একটু তাড়াতাড়ি পাঠাবেন আপা। শিরীন ঝর্ণার বিয়ের ব্যাপারটা জানত না। এতদিন পরে ঝর্ণাকে দেখে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে এগিয়ে এসে বলল, কিরে এখন কোথা থেকে এলি? তারপর তার বিধস্ত চেহারার দিকে লক্ষ্য পড়তে আতঙ্কিত স্বরে বলল, কি ব্যাপার, তাের এরকম অবস্থা কেন? র্ণা বলল, পরে সব বলব আগে দশটা টাকা কাউকে দিয়ে নিচে পাঠিয়ে দে, রিক্সাওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে।
শিরীন টাকাটা কাজের মেয়ের হাতে পাঠিয়ে দিল। তারপর ঝর্ণার হাত ধরে পাশাপাশি বসে বলল, কি ব্যাপার খুলে বলতাে? আমি কিন্তু তােদের কাছে কয়েকদিন থাকব বলে এসেছি। যতদিন ইচ্ছা থাকিস। আগে বল তাের এরকম অবস্থা কে করল?
ঝর্ণা বলতে গিয়ে ফুপিয়ে উঠে শিরীনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। | শিরীন ঝর্ণাকে দেখার পর থেকে আতঙ্কিত হয়ে আছে। এখন তাকে কাঁদতে দেখে। আরাে বেশি আতঙ্কিত হয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে প্রবােধ দিতে গেলে ঝর্ণা উহু লাগছে বলে হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, হাত দিবি না। সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা।। শিরীন অবাক হয়ে বলল, ব্যথা! কি হয়েছে বলতাে? ঝর্না সামলে নিয়ে পিঠের ও হাত-পায়ের কাপড় সরিয়ে বলল, আগে এগুলাে দেখ, তারপর বলছি।।
শিরীন দেখে চমকে উঠল। তার সারা শরীরে মারের আঘাতে জায়গাগুলাে ফুলে। গেছে। সেগুলাে থেকে রক্ত বেরিয়ে শুকিয়ে গেছে। সে বােবা হয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার। মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।।
তাকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে দেখে ঝর্ণা বলল, কিরে, তুই মারের চিহ্ন দেখে ভয় পেয়ে গেলি? এ রকম মার খেলে তা হলে কি করতিস? শিরীন বলল, কি করতাম জানি না, এখন তুই বল কে তাের সঙ্গে এমন পশুরমতাে ব্যবহার করল? | ঝর্ণা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বিয়ে হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে। সব বলল। তারপর চোখ মুছে বলল, খুব পিয়াস লেগেছে, একগ্লাস ঠান্ডা পানি দেত।
কাজের মেয়েটা রান্না ঘরে ছিল। শিরীন তাকে ডেকে বলল, এক জন মেহমানের জন্য বেশি করে রান্না করবে। এখন সিভিটা দিয়ে এক গ্লাস সরবত করে নিয়ে এস।
কাজের মেয়েটা সরবত দিয়ে চলে যেতে শিরীন বলল, তাের জন্য দুঃখ হচ্ছে। তুই কত বড়লােকের মেয়ে, তাের আজ এই অবস্থা? যা বললি তারপর তাে তুই আমিনের কাছে বা বাপের কাছে ফিরে যেতে পারবি না। কি করবি কিছু ভেবেছিস? ভাববার সময় পেলাম কই। তাের কাছে কয়েকদিন থেকে ভেবেচিন্তে যা হােক কিছু করব।
হ্যা, তাই করিস। তাের ডাক্তার এখনও ফিরে নি? সে এত তাড়াতাড়ি ফিরবে? বিকেলে মেডিকেল থেকে ফিরে ধানমণ্ডিতে একটা ক্লিনিকে বসে। ফিরতে রাত দশ-এগারটা বেজে যায়।। শিরীনের স্বামী জায়েদ এগারটায় ফিরে ঝর্ণার সব কথা শুনে দুঃখ প্রকাশ করে। বলল, আপনি যদি চান, তা হলে কেস করে পাষণ্ডটাকে জেলে পাঠাতে পারি ।।
ঝর্ণা বলল, সে সব পরে চিন্তা করব। আপাততঃ আপনি আমার জন্যে একটা চাকরির। ব্যবস্থা করুন। তা না হলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার আর কোনাে রাস্তা খােলা নেই। জায়েদ বলল, এ রকম ভয়ঙ্কর কথা বলবেন না। আপনি শিরীনের বান্ধবী। আপনাকে আমি আপন বােনের মতাে মনে করে বলছি, যতটুকু পারি সাহায্য করব। কোনােদিন আত্মহত্যার কথা ভাববেন না। এই কাজ যারা করে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করেন না।
শিরীনের আব্বা আহম্মদ উল্লাহ সাহেব ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। একটা ইসলামী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। জায়েদ কলেজে পড়ার সময় থেকে ঐ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। আহম্মদ উল্লাহ সাহেব জায়েদের উন্নত চরিত্রে আকৃষ্ট হয়ে একমাত্র মেয়ে শিরীনের। সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন। তিনি একদিকে যেমন বিরাট ব্যবসায়ী, অন্যদিকে তেমনি দেশের ও দশের জন্যে নিবেদিত প্রাণ। বর্তমানে উচ্চ শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা যাতে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করে সেই মতাে চলে, সেই জন্য তিনি এই সংগঠন করেছেন।
নিজের মেয়েকে কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেও ছােটবেলা থেকে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে সেই মতাে মানুষ। করেছেন। তাই শিরীন ক্লাস নাইন থেকে ভার্সিটি পর্যন্ত বােরখা পরে ক্লাস করত
ভার্সিটিতে শিরীনের বােরখা পরা নিয়ে অনেক ছেলেমেয়ে হাসাহাসি করত। একদিন। কমন রুমে মেয়েরা শিরীনকে নিয়ে মজা করার জন্য তাদের মধ্যে একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই বােরখা পরিস কেন? তাের কি বিয়ে হয়ে গেছে? আমরা তাে জানি গোড়া মুসলমানের মেয়েরা বিয়ের পর বােরখা পরে ঘরের বাইরে বেরােয়। | শিরীন বলল, তােদের ঐ জানাটা ভুল। তােরা ধর্মীয় বই একদম পড়িস না বলে। এই রকম কথা বলছিস। যদি পড়তিস, তা হলে জানতে পারতিস
পথিবীর সমস্ত সাবালিকা মেয়েদের বােরখা পরে ঘরের বাইরে বেরােন উচিত। যে কোনাে জিনিস আলােচনা করতে হলে, তা ভালাে-মন্দ জ্ঞান রাখতে হয়। এখন আমি যদি তােদেরকে বলি বােরখা পরার ভালাে-মন্দ বিশ্লেষণ কর, পারবি কি? পারবি না। এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দে, মানুষ জামা-কাপড় কেন পরে?
অন্য একটা মেয়ে বলল, এটা আবার একটা প্রশ্ন হল? সবাই জানে, ইজ্জৎ ঢাকার জন্য জামা-কাপড় পরে।
শিরীন বলল, তাই যদি হয়, তা হলে পুরুষরা জামা-কাপড় পরে তাদের শরীরের কোনাে অংশ মেয়েদের দেখায় না। আর মেয়েরা কেন তা পরেও পুরুষদেরকে তাদের শরীরের অনেক লােভনীয় অংশ দেখায়? অথচ সবাই জানে পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের। লজ্জা বেশি।
এ কথারও তােরা উত্তর দিতে পারবি না। তােরা আমাকে ভুল বুঝিস না। কথাটা যখন তারা তুলেছিস তখন দু’একটা কথা না বলে পারছি না। আমরা বিভিন্ন । বিদ্যাপীঠে জ্ঞান অর্জন করার জন্য আসি। কিন্তু আমরা কি তা করছি? করছি না। আমরা শুধু ডিগ্রি নিতে আসি। অনেকে হয়তাে বলবি, আমরা ডিগ্রির সঙ্গে জ্ঞানও অর্জন করছি।
তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, জ্ঞান অর্জন করার পর কি কেউ অজ্ঞানের মতাে কাজ করতে পারে? মানুষ জ্ঞান অর্জন করে ভালােমন্দ বোেঝার জন্য। মন্দকে ত্যাগ করে ভালােকে গ্রহণ করার জন্য। আর তখনই জ্ঞান অর্জনের সার্থকতা যখন জ্ঞানের প্রতিফলন নিজের জীবনে প্রতিফলিত করবে। আসলে আমরা তা না করে শুধু ডিগ্রি নেয়ার জন্য উচ্চ শিক্ষা নিতে আসি। জ্ঞান অনুযায়ী কেউ অনুশীলন করাকে নির্বুদ্ধিতা। মনে করি।
তাই আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা এবং হযরত মােহাম্মদ (দঃ)-কে পৃথিবীর সব যুগের শ্রেষ্ঠ মানব জেনেও তাদের আদেশ মেনে চলছি না। আর যারা আদেশ মেনে। চলার চেষ্টা করে, তাদেরকে নিয়ে আমরা বিদ্রুপ করি, হাসি মস্করাও করি।।
শিরীনের কথা শুনে কেউ কোনাে কথা বলতে পারল না।
ইউনিভার্সিটিতে সেদিন শিরীনের কথা ভালাে লাগলেও অন্যদের মত ঝর্ণাও মেনে নিতে পারে নি। কিন্তু শিরীনের মধুর ব্যবহারে আকৃষ্ট হয়ে তর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। সেই শিরীনের বাসায় কয়েকদিন থেকে বুঝতে পারল, এদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কত সুন্দর। সংসারটা যেন শান্তির নীড়। একদিন কথায় কথায় শিরীন বলল, জানিস, শিক্ষিত অশিক্ষিত নারী-পুরুষ ধর্মের জ্ঞান না পেয়ে এবং যারা কিছু কিছু তা পেয়েও সেই মতাে অনুশীলন করছে না বলেই সমাজের এত অবক্ষয়। তােকে অনুরােধ করছি, আমাদের।
অনেক ধর্মীয় বই রয়েছে, সেগুলাে পড়। দেখবি, তুই যেন অন্য জগতে চলে গেছিস। আল্লাহ ও তার রাসূল (দঃ) প্রত্যেক নর-নারীর জ্ঞান অর্জন করাকে অবশ্য কর্তব্য। বলেছেন। কিন্তু সেই জ্ঞান কি জ্ঞান, সেটা চিন্তা করা প্রত্যেকের কর্তব্য।
জ্ঞান অর্জন বলতে কেউ যদি শুধু স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানকে বােঝে, তবে সে যেমন ভুল করবে, আবার যদি কেউ শুধু ধর্মীয় শিক্ষাকে বােঝে, তা হলে সেও তেমনি ভুল করবে। কারণ জ্ঞানের কোনাে সীমাবদ্ধতা নেই।
মানুষ যে কোনাে বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারে। তবে সে জ্ঞান যেন মানুষের কল্যাণে আসে। মানুষকে সব সময় মনে। রাখতে হবে, যে জ্ঞান আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) আইনের পরিপন্থী তা পরিত্যাগ করতে হবে। আর তা জানার জন্য আল্লাহপাকের কুরআন ও রাসূল (দঃ)-এর হাদিসের ব্যাখ্যা। পড়তে হবে। আমরা তা করছি না বলে আজ সারা বিশ্বে মুসলমানরা সব থেকে ঘৃনিত, আর সমাজে এত অশান্তি।
Part: 1 | Part: 2 | Part: 3 |
0 Comments
Please Don't Send Any Spam Link